Advertisement
E-Paper

ভুলেও বামের সঙ্গে জোট কোরো না মমতার ‘উপদেশ’ শোনালেন রাহুল

কংগ্রেস সহ-সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা বামেদের হাত ধরতে চেয়ে সওয়াল করবেন, প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেই আসরেই প্রদেশ নেতাদের চমকে দিয়ে ‘অজানা কথা’ ফাঁস করে দিয়ে রীতিমতো বোমা ফাটালেন স্বয়ং রাহুল গাঁধীই!

শঙ্খদীপ দাস

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:১৯

কংগ্রেস সহ-সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা বামেদের হাত ধরতে চেয়ে সওয়াল করবেন, প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেই আসরেই প্রদেশ নেতাদের চমকে দিয়ে ‘অজানা কথা’ ফাঁস করে দিয়ে রীতিমতো বোমা ফাটালেন স্বয়ং রাহুল গাঁধীই!

তুঘলক লেনে কংগ্রেসের যুবরাজের বাসভবনে অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে রাজ্য কংগ্রেসের একের পর এক নেতা যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন এবং বামেদের সঙ্গে জোট করার ফায়দা ব্যাখ্যা করছেন, তখনই তাঁদের সঙ্গে একটি ‘অজানা কথা’ ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাহুল। জানান, কয়েক মাস আগে পটনায় নীতীশ কুমারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডেকে একটা উপদেশ দিতে চেয়েছিলেন। উৎসুক রাহুল জানতে চেয়েছিলেন, কী উপদেশ? ‘মমতাজি’র মন্তব্য ছিল, আর যা-ই হোক কংগ্রেস যেন সিপিএমের সঙ্গে জোট না করে!

গল্পের মোড়কে পেশ করা এই ‘অজানা কথা’র মধ্যেই রাহুলের মনোভাব আজ পড়ে নিতে চেয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘তার মানে রাহুল আর যা-ই হোক, তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে চান না! তা না হলে মমতার ওই মন্তব্যের কথা আমাদের বলে দিতেন না!’’ কংগ্রেসেরই কেউ কেউ আবার বলছেন, পটনার গল্প বলে রাহুল একই সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের উপরে তৃণমূলের দিক থেকে ‘চাপে’র কথাটাও কৌশলে অধীরদের সামনে পেড়ে রাখলেন! এবং একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন যে, জোট নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী।

বৈঠকের অন্দরে বলা রাহুলের পটনা-কাহিনি কংগ্রেস রাজনীতির চেনা ছক মেনে যথারীতি বাইরে বেরিয়ে পড়েছে! তা কানে যাওয়া মাত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে তৃণমূল শিবির থেকে! দলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন পাল্টা দাবি করেছেন, তাঁদের দলনেত্রীকে জড়িয়ে এই কাহিনি পুরোপুরি মিথ্যা! এমন গল্প প্রচার করা হলে তাঁরা কড়া প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হবেন।

ডেরেকদের প্রতিবাদ যেমনই হোক না কেন, রাহুল যে অন্তত তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে নেই, আজকের বৈঠকে পটনার গল্প শুনেই প্রদেশ নেতারা বুঝে নিয়েছেন! বৈঠকের মধ্যেই প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র হাসতে হাসতে মন্তব্য করেন, আসলে তৃণমূল নেত্রী খুব ‘নার্ভাস’ হয়ে আছেন! রাহুল অবশ্য সে ব্যাখ্যায় যাননি। তবে রাজ্য নেতাদের মতামত শোনার পর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অতীতে কংগ্রেস যে ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি করতে তিনি নারাজ। কেন্দ্রে সরকারের স্বার্থে বা জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় রাজ্যে রাজ্যে বহু বার আপস করা হয়েছে। কিন্তু এখন রাজ্যের নেতাদের মতামতকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে।

রাহুলের সঙ্গে বৈঠকের পরে বাম জোটের ব্যাপারে খুবই উৎসাহিত প্রদেশ কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এ দিনের বৈঠকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তৃণমূলের সঙ্গে কেউই আঁতাঁত চান না এবং অন্তত এই ক্ষেত্রে রাহুলের মতও আলাদা নয়। তবে রাহুল এ-ও জানেন, মায়ের মন মমতার প্রতি ঈষৎ নরম। তাই তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছেন তিনি।

সিপিএম যেমন এখন সনিয়ার সবুজ সঙ্কেতের জন্য অপেক্ষা করছে এবং একই সঙ্গে ঘর গোছাচ্ছে, তৃণমূলও তেমন বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে জোটের বল গড়াচ্ছে। তাই কখনও বিরোধী জোটকে কটাক্ষ, কখনও উপেক্ষা— নানাবিধ কৌশল নিয়ে চলছেন রাজ্যে শাসক দলের নেতারা। যা থেকে আসলে তৃণমূল নেতৃত্বের উদ্বেগই স্পষ্ট বলে বিরোধীদের অভিমত। তৃণমূলের তরফে ডেরেক যেমন বলেছেন, ‘‘তৃণমূল আগেই জোট করে নিয়েছে। সেটা মানুষের সঙ্গে জোট। এখন দেখা যাচ্ছে, ৩৪ বছর অপশাসন করে বাংলাকে ধ্বংস করা একটি দল অস্তিত্বহীন একটি দলের সঙ্গে জোট করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে!’’ পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুভেন্দু অধিকারী, বিভিন্ন নেতাই দলীয় কর্মী সম্মেলনে সম্ভাব্য জোটকে কটাক্ষ করছেন। তারই মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছেন, ‘‘জোট হলে আমাদের আসন বাড়বে! যারা কংগ্রেসের লোক, তারা সিপিএমের অত্যাচারের কথা ভুলতে পারবে না। ফলে, আমাদেরই ভোট দেবে।’’ যে সব প্রতিক্রিয়া শুনে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী পাল্টা বলেছেন, ‘‘অস্তিত্বহীন দল কী করবে, তা নিয়ে এত না ভেবে ওঁরা বরং নিজেদের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের দিকে নজর দিন!’’

বিধানসভা ভোটের আগে দলের কৌশল নির্ধারণের জন্য প্রদেশ নেতাদের মতামত জানতে আজ তাঁদের দিল্লিতে বৈঠকে ডেকেছিলেন রাহুল। সকালে ১২ নম্বর তুঘলক লেনের বাইরে ছবিটা ছিল ক্যামেরা-বন্দি করে রাখার মতোই! হাইকম্যান্ডের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে রাজ্য কংগ্রেসে এমন উন্মাদনা বহু দিন দেখা যায়নি! সবার শেষে হাঁফাতে হাঁফাতে বৈঠকে পৌঁছন মালদহের সাংসদ আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরী! ‘লাস্ট ম্যান ফার্স্ট’ মন্তব্য করে রাহুল তাঁকেই আগে বলার সুযোগ দেন। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ডালুবাবু বলেন, কংগ্রেসকে খতম করতে চাইছে তৃণমূল। তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। একলা চলার পরিস্থিতিও নেই। মানুষ বাম-কংগ্রেস জোট চাইছেন। একই মত জানান সোমেনবাবু, প্রদীপ ভট্টাচার্য, আব্দুল মান্নান, ওমপ্রকাশ মিশ্র, অমিতাভ, মৌসম বেনজির নূর, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়েরা। তাঁদের মতে, নিচু তলায় কংগ্রেস ও বাম কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় শুরু হয়ে গিয়েছে। এর পরে অন্যথা করলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে অমর্যাদা করা হবে।

জোটের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে অধীর রাহুলকে বলেন, অতীতে সিপিএম তাঁর উপরে যে অত্যাচার করেছে, সম্ভবত কংগ্রেসের আর কোনও নেতাকে তা সহ্য করতে হয়নি! বাম জমানায় শুধু মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের প্রায় ৬০০ কর্মী খুন হয়েছেন। কিন্তু ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভনে কংগ্রেসকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার চেষ্টা তৃণমূলের মতো কেউ করেনি। নিচু তলার কংগ্রেস কর্মীরাও বামেদের সঙ্গে জোট চাইছেন।

তবে প্রত্যাশা মতোই বামেদের সঙ্গে জোট নিয়ে আপত্তি করেন সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। একলা চলার দাবি জানান মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুব্রতা দত্তও। মানসবাবু বলেন, সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কংগ্রেসের একা চলা উচিত। রাহুল পাল্টা জানতে চান, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় কম করে পাঁচটি আসন মানসবাবু জেতাতে পারবেন তো! গোড়ায় একলা চলার পক্ষে মত দিলেও দীপা দাশমুন্সি পরে অবশ্য রাহুলকে বলেন, বামেরা একটা নয়, চারটে দল। জোট হলে কী ভাবে আলোচনা হবে, তার কোনও পরিকাঠামো এখনও স্থির হয়নি। কংগ্রেস যেখানে শক্তিশালী, সেখানে স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কোনও জোট যাতে না হয়, তা খেয়াল রাখতে বলেন দীপা।

অপেক্ষায় সিপিএম, বসছে পলিটব্যুরোও
নিজস্ব সংবাদদাতা

দিল্লিতে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের বৈঠকের নির্যাস প্রাথমিক ভাবে ‘ইতিবাচক’ বলেই মনে করছে সিপিএম। তবে সনিয়া গাঁধীর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না জেনে এখন থেকেই কোনও বাড়তি প্রতিক্রিয়া বা উচ্ছ্বাসে নারাজ তারা। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সোমবার জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা আলোচনা করবেন। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যেরও বক্তব্য, ‘‘আমরা তৃণমূলকে উৎখাত করার জন্য সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে একজোট করে লড়াইয়ের কথা বলেছি। বারবার কারও উদ্দেশে একই কথা বললে জোটের প্রক্রিয়ার জন্য সেটা ভাল হয় না। কংগ্রেস দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া আছে। তারা কী সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেয়, দেখা যাক।’’ তবে কংগ্রেসের দিক থেকে ইতিবাচক সঙ্কেত এলে তারা কী ভাবে সাড়া দেবে, তার জন্য দলীয় স্তরে প্রস্তুতি শুরু করে দিচ্ছে সিপিএম। দিল্লিতে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পলিটব্যুরো ও ১৭-১৮ তারিখ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। রাজ্য কমিটির বৈঠকের নির্ঘণ্ট স্থির করার আগেও কংগ্রেস শিবিরের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সিপিএম। কংগ্রেসের মত আর একটু স্পষ্ট হলেই রাজ্য কমিটির বৈঠক ডাকা হবে চলতি মাসের মাঝামাঝি।

rahul gandhi congress high command alliance MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy