একই কাজ। একটি বেসরকারি সংস্থা তার জন্য ১৭ কোটি টাকা নিলেও অন্য একটি সরকারি সংস্থা করে দিয়েছে ৫ কোটিতে।
সাগরে গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে মুড়িগঙ্গা নদীতে পলি সংস্কারের যে কাজ হয়েছে, সেখানেই পর পর দু’বছরের খরচের খাতায় এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বলছেন— ৫ কোটিতে যে কাজ হয়ে যায়, তার জন্য ১৭ কোটি টাকা খরচ করা হলে ধরতে হবে এর পিছনে ‘গভীর রহস্য’ রয়েছে। তবে সেটা কী— তা নিয়ে জেলা থেকে রাজ্য প্রশাসনের কোনও কর্তা মুখ খুলতে নারাজ। কারণ, তাঁদের আশঙ্কা— কেঁচো খুড়তে গিয়ে কেউটে বেরোতে পারে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, নাব্যতা বাড়াতে নদী থেকে পলি তোলার জন্য ওই বেসরকারি সংস্থাকে টানা তিন বছর (২০১২-১৪) বরাত দিয়েছে রাজ্য মৎস্য দফতরের সমবায়। সরকারি সূত্রের খবর, ওই বেসরকারি সংস্থাটিকে এখন ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এমন একটি সংস্থা টানা তিন বছর কী করে কাজের বরাত পেল, এর পিছনে প্রশাসনের কারও ‘লম্বা হাত’ রয়েছে কি না— তদন্ত না-করে সেই প্রসঙ্গ ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
ফি বছর জানুয়ারিতে গঙ্গাসাগর মেলায় কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। সে জন্য প্রতি বছর নদী সংস্কার, পূণ্যার্থীদের ছাউনি তৈরি, রাস্তা ও জেটি সংস্কারের কাজ করে সরকার। মেলার জন্য খরচ হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। গত বছর এই মেলাকে ‘নির্মল মেলা’ ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে জন্য অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। নবান্নের এক কর্তা জানান, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মেলা আয়োজনের মূল দায়িত্বে থাকে জনস্বাস্থ্য কারিগরি ও গ্রামোন্নয়ন দফতর। কিন্তু সংস্কারের কাজগুলি করে একাধিক বেসরকারি সংস্থা। দরপত্রের মাধ্যমে তাদের কাজের বরাত দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, মেলার মাস দুয়েক আগে হারউড পয়েন্ট থেকে কচুবেড়িয়া ও বেনুবন পয়েন্ট থেকে চেমাগুড়ি— প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কিউবিক মিটার জলপথে পলি তোলার বরাত দেওয়া হয় প্রতি বছর। দরপত্রের মাধ্যমে কোনও বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে ওই কাজ করায় মৎস্য সমবায়। রাজ্যে মাছের উৎপাদন বাড়ানো এবং মাছ চাষে সাহায্য করাই যে দফতরের মূল কাজ, তারা কী করে সাগর মেলার পলি তোলার কাজের বরাত দেওয়ার দায়িত্ব পেল— তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মৎস্য সমবায়ই পর পর তিন বছর একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে কাজের বরাত দিয়েছে। কিন্তু কেন?
মৎস্য সমবায়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘এ রাজ্য কেবল ওই ঠিকাদার সংস্থারই নিজস্ব ড্রেজিং মেশিন রয়েছে। আর ওই কাজের অন্যতম শর্ত নিজস্ব ড্রেজিং মেশিন থাকা। টেন্ডারে তিনটি সংস্থা সাড়া দিলেও কেবল ওই সংস্থাটিই সব শর্ত পূরণ করেছে। তাই তারাই কাজ পেয়ে এসেছে।’’ অমিতাভবাবু জানান, ড্রেজিংয়ের জন্য ঠিকাদার সংস্থাটি যা চেয়েছে, সেটাই দিতে হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা ঠিক মতো কাজ করছে কি না, কত পলি তারা কাটছে, তা তদারকির ব্যবস্থা ছিল কি? মৎস্য সমবায়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দাবি, ড্রেজিং চলাকালীন দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা কাজের তদারক করতেন।
অমিতাভবাবু এই নিয়োগের পক্ষে যুক্তি দিলেও, ফি বছরই ওই সংস্থার কাজ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠে জেলা প্রশাসনের অন্দরে। যেমন, যে পদ্ধতিতে পলি তোলার কথা, তা তারা মানেনি। কাজ শেষের পরেও বিস্তর পলি থেকে গিয়েছে। ২০১৫-র জানুয়ারিতে মেলা চলাচাকালীনই পলির কারণে নদীতে টানা ১৮ ঘণ্টা লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর পর এ বার জানুয়ারিতে সাগর মেলার কয়েক মাস আগে কেন্দ্রের অধীনস্থ সংস্থা ‘ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ লিমিটেড’-কে কাজের বরাত দেয় জেলা প্রশাসন। সে কাজে নজরদারি করে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। মাত্র ৫ কোটি টাকাতেই সব কাজ হয়ে যায়।
১৭ কোটির কাজ কেন্দ্রীয় সংস্থাটি পাঁচ কোটিতে করল কী করে? মৎস্য সমবায় দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা— অন্য বছর ৪টি পয়েন্টে ৩০ দিন ধরে পলি তোলা হয়। কেন্দ্রীয় সংস্থাটি ২০ দিন কাজ করেছে। তা ছাড়া, পলি কাটাও হয়েছে তুলনায় কম এলাকায়। তাই খরচ কমতে পারে। তা হলে আগের সংস্থাটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হল কেন— এই প্রশ্নের অবশ্য কোনও জবাব দিতে পারেননি মৎস্য দফতরের কর্তারা।
গোটা বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্তারা প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেও আর্থিক কেলেঙ্কারির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ‘‘এই নিয়ে খোঁচাখুঁচি করলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোবে। তাই সব দেখেও কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছেন না,’’ মন্তব্য জেলা প্রশাসনের এক কর্তার। বেসরকারি সংস্থাটির পক্ষে অবশ্য কেউ কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পিভি সেলিম বলেন, ‘‘স্বচ্ছতা বজায় রাখতে রাজ্য সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নবান্নের নির্দেশে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।’’
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য কি পরবর্তী কালে এই ধরনের কাজ সরকারি সংস্থাকে দিয়েই করাবে? এই প্রশ্নের জবাবে নবান্নের এক কর্তা বলেন, ‘‘গঙ্গাসাগরের কাজ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল বলেই সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছতা রেখে ই-টেন্ডারের মাধ্যমেই সরকারি কাজ দেওয়া হয়। অন্য ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাই চালু থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy