Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পাচারের পাঁচকাহন-২

পদ্মা পেরিয়ে যায় পেপসি

পাচার নিষিদ্ধ। ওঁরা জানেন। কিন্তু মানতে চান না। উল্টে দাবি করেন, এ তো ব্যবসা। সেই ‘ব্যবসা’য় লাভ আছে। জীবনের ঝুঁকি আছে আরও বেশি। তবুও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হয়নি। বরং বদলেছে তার কৌশল। বদলেছে পাচার সামগ্রী।‘ডিল আছে আরডি-তে। বিহানের আগেই তুলে নিস ভাই...।’ফোনটা শেষ হতেই এ দিক ওদিক তাকালেন ডোমকলের বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক।

নদীর চরে গরু পাচারের ‘ট্র্যাক’।   ছবি— গৌতম প্রামাণিক

নদীর চরে গরু পাচারের ‘ট্র্যাক’। ছবি— গৌতম প্রামাণিক

সুজাউদ্দিন ও কল্লোল প্রামাণিক
ডোমকল ও করিমপুর শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০০:৫০
Share: Save:

‘ডিল আছে আরডি-তে। বিহানের আগেই তুলে নিস ভাই...।’

ফোনটা শেষ হতেই এ দিক ওদিক তাকালেন ডোমকলের বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক। তারপর সিঙ্গল স্ট্রোকে বুলেট স্টার্ট দিয়ে মিলিয়ে গেলেন পথের বাঁকে। ভ্যাবাচাকা ভাব সামলে ওঠার আগেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন পথের ধারের মাঝবয়সী চায়ের দোকানদার, ‘‘কিছু বুঝলেন কর্তা?’’

উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনিই বিজ্ঞের মতো বলে চলেন, এই ‘আরডি’ বর্মন নয়, গর্ত। বর্ডারের আশপাশে সেই গর্ত খুঁড়ে রাখা হয় গাঁজা কিংবা ফেনসিডিল। তারপর ফোন করে দেওয়া হয় ওপার বাংলার কোনও পাচারকারীকে। সময় সুযোগ বুঝে সে এসে তুলে নিয়ে যায় ‘যখের ধন’। গর্তের আশপাশে নির্দিষ্ট জায়গায় গোপন চিহ্নও দেওয়া থাকে। যা দেখে গর্ত খুঁজে পেতে কোনও সমস্যা হয় না।

সীমান্তের আট থেকে আশি সকলেই ‘আরডি’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তর গর্তকে কেন আরডি বলা হয় সে প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলে না। এ তো গেল গর্ত-কাহিনী। মাস কয়েক আগে মুদির দোকান থেকে একটি তালিকা এসেছিল জলঙ্গি থানার পুলিশের হাতে। সেই তালিকা দেখেও চোখ কপালে উঠেছিল জেলা পুলিশের এক কর্তার। সাদা পাতায় খারাপ হস্তাক্ষরে লেখা ছিল— ‘ছোলার ডাল- দশ কেজি, মুসুর ডাল- দশ কেজি, মশলা- পাঁচ কেজি, বাঁচার লাঠি- বারোটি, দু’শো ব্যাটারি।’

এক ঝটকায় দেখে মনে হতেই পারে, “এ তো বাজার করার লিস্টি গো।” কিন্তু বারকয়েক সেই তালিকা পড়ার পরে দুঁদে পুলিশ কর্তা হোঁচট খান ‘বাঁচার লাঠিতে’। মুদির দোকানে ডাল-মশলা না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু বাঁচার লাঠি বস্তুটি কী? রানিনগর সীমান্তের এক মুদির দোকানের মালিককে পাকড়াও করে কিঞ্চিৎ কড়কে দিতেই খুলে যায় কোডের জট।

ডাল মানে হল গিয়ে ওই ফেনসিডিল। ছোলা মানে বড় শিশি। আর মুসুর মানে ছোটটা। বাঁচার লাঠি হচ্ছে ওয়ান শটার। ছোট টর্চ বলা হয় পিস্তলকে। বড় টর্চ মানে পাইপগান। মশলা মানে বোমার মশলা। আর ব্যটারি? টেবিলের উল্টো দিক থেকে সেই মুদি ঢোক গিলে জানান, “আজ্ঞে গুলি স্যার। ওতেই তো টর্চ জ্বলে।” আরও আছে। গরুকে গরু বললে নিশ্চয় নিরীহ চতুষ্পদটির রাগ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাবধানের মার নেই। অতএব ছোট গরু হয়ে যায় পেপসি। বড় গরু বোল্ডার। আর ফেনসিডিলকেই যে আদর করে ডিল বলে সে কথা জানে তামাম সীমান্ত! কোডের গিঁট খুলতে পেরে হাসছেন সেই পুলিশ কর্তা, ‘‘উফ্, বলিহারি সব কোডের কেরামতি। এই সব জিনিস দেখলে ০০৭ সাহেবও বোধহয় ঘেঁটে ঘ হয়ে যেতেন।’’ গত কয়েক বছরে সীমান্তে নজরদারি বেড়েছে অনেকটাই। নজরদারি ও সুরক্ষার স্বার্থে জেলা পুলিশ থেকেও বার বার সতর্ক করা হয় সীমান্তবর্তী থানাগুলোকে। কাঁটাতার বসানো হয়েছে সীমান্তের বেশ কিছু নতুন এলাকায়। তবে পাচার কিন্তু বন্ধ হয়নি। উল্টে পুরনো পথ ছেড়ে পাচারকারীরাও কখনও কোড, কখনও অন্য পন্থা বেছে নিচ্ছে।

নদিয়ার সীমান্তের এক বিএসএফ কর্তার কথায়, ‘‘সীমান্ত এলাকায় এমন কিছু দোকান ও বাড়ি রয়েছে যেখানে মজুত রাখা হয় গাঁজা কিংবা কাশির সিরাপ। কখনও কখনও বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রও রাখা হয়। অথচ বাইরে থেকে সেসব বোঝার কোনও উপায় নেই। পাচারের গোটা ব্যাপারটাই নিয়ন্ত্রিত হয় ফোন এবং নির্দিষ্ট কিছু লোকের মাধ্যমে।’’

কিন্তু এই কোড লেখা কাগজ বা তালিকা দিয়ে কী ভাবে চলছে পাচার?

নদিয়ার এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘কাগজে লেখা ওই তালিকা নানা হাত ঘুরে বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসছে। তারপর সেই তালিকা নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দিতে পারলেই মিলবে চাহিদা মতো জিনিস। এর জন্য কোনও নগদ টাকা দেওয়ারও দরকার হয় না। টাকা-পয়সার কারবার চালায় অন্য চক্র। ওই দোকান মালিক সেই চক্রের কাছে ওই তালিকা দিলেই হাতে পেয়ে যাবে নগদ টাকা। এটাই এই কারবারের একমাত্র শর্ত।’’

মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলছেন, ‘‘পাচারকারী সঙ্গে কথা বলে উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কিছু গোপন কোডের রহস্যও। পাচার রুখতে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি সীমান্তবর্তী থানাগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।’’

কোডের জট না হয় খুলল! কিন্তু সীমান্তের রাস্তা দিয়ে এত ঘন ঘন ‘প্রেস’ কিংবা ‘পুলিশ’ লেখা গাড়ির যাতায়াত বাড়ছে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cow smuggling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE