সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বৃহত্তর বাম ঐক্যের চাইতে অনেক বেশি আগ্রহী কংগ্রেস-সহ ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনী জোট বা বোঝাপড়া করতে। এ কথা আজ আর নতুন কিছু নয়। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনের পর অন্যান্য সংদীয় বামপন্থী দলকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস, বিজেপি-র পাল্টা জাতীয় স্তরে একটি ‘বাম ব্লক’ গড়ে তোলার পক্ষেও সিপিএম নীতিগত ভাবে একমত হয়েছিল। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, সিপিএমে ইয়েচুরির মতই বেশি করে প্রাধান্য পেয়েছে। তাই, বৃহত্তর বাম ঐক্যের পথে না হেঁটে সিপিএম ভোটের অঙ্কই বেশি করে হিসেব করছে। তাই, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন বা এসইউসি-র মতো দলের পশ্চিমবঙ্গ বা কেরলে সংগঠন থাকলেও তা ভোটের বাক্সে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না বলে সিপিএম প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে নিয়ে জোটের কথা বলতে শুরু করেছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে কংগ্রেসের ৭ শতাংশ ভোট অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সিপিএমের কাছে।
নীতি এবং ভোট, দুইয়ের মধ্যে সংসদীয় রাজনীতিতে ভোট-ই যে গুরুত্বপূর্ণ তা প্রতি পদক্ষেপে বুধিয়ে দিচ্ছে সিপিএম। সংসদীয় রাজনীতিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সংসদে দলীয় উপস্থিতি-ই শেষ কথা বলে মনে করেন ইয়েচুরির মতো নেতারা। সিপিএম-এ তো বটেই এই মতের সমর্থকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শরিক বাম দলগুলিতেও। তিন দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার স্বাদ যারা পেয়েছে তারা কী ‘মূর্খের’ মতো কেবল ‘বাম ব্লক’ গড়ে তোলার মতো ‘রোমান্টিক’ কাজকে গুরুত্ব দেবে! তাই, সিপিএম এবং ফ্রন্টের অধিকাংশ শরিক এখন মনে করছে, কংগ্রেসের ৭ শতাংশের সঙ্গে বামেদের ২৩ শতাংশ যোগ করলে তৃণমূলকে যুঝতে অনেকটাই সুবিধা হবে বলে।
ইয়েচুরির জোট দর্শনকে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ কমরেড সমর্থন করেন। ধর্ম-নিরপেক্ষ দল বলতে কংগ্রেস, জনতা পরিবারের দলগুলি এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দলকে মনে করে সিপিএম। এই দলগুলির কারও সঙ্গে সিপিএম সমঝোতা করতেই পারে, তাতে কিন্তু বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবে। কারণ, কংগ্রেস, নীতিশ, লালু বা মুলায়মের সঙ্গে লিবারেশন বা এসইউসি এক পাতে ভাত খাবে না। কারণ, বামফ্রন্টের বাইরের বামপন্থী দলগুলি মনে করে, কংগ্রেস চরিত্রগত ভাবে পুঁজিপতিদের-ই প্রতিনিধিত্ব করে। আর, নীতিশ-লালু-মুলায়ম- মায়াবতী এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলি সুবিধাবাদী রাজনীতি করে। প্রয়োজনে জাত-পাতের রাজনীতিও করে। এই দলগুলির নেতৃত্ব বক্তিগত স্বার্থে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করবেন না। অতীতে এর একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বাম ঐক্য আরও জটিল হয়ে পড়ল।
সম্প্রতি এ রাজ্যে সিপিএম-এর শীর্ষ নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে মরিয়া হযে উঠেছেন তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে্ বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক সিপিআই। দলের বর্ষীয়ান নেতা মঞ্জুকুমার মজুমদার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করায় তাঁদের আপত্তির কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘৭২ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে কিছু আসন আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তার খেসারত আমরা আজও দিচ্ছি। কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়ার দরুণ আমাদের সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ফের যদি সেই একই ভুল করি তা হলে ভবিষ্যতে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।’’ তা ছাড়া, গত চার বছর ধরে সিপিআই (এমএল) লিবারশেন, এসইউসি-র মতো দলকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর বাম ঐক্যের জন্য যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সিপিআই সেক্ষেত্রেও দল অস্বস্তিতে পড়বে বলে সিপিএম-কে জানিয়েছেন সিপিআই নেতৃত্ব। গত বছর দলের পার্টি কংগ্রেসে সিপিআই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কংগ্রেস এবং বিজেপি-র সঙ্গে সম-দূরত্ব বজায় রাখবে এবং বিরোধিতাকে আরও তীব্র করবে। দলের আর এক নেতা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনেই আমরা চলতে চাই। বাম দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করাই আশু কর্মসূচি হওয়া উচিত।’’
সিপিএম যদি কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে তা হলে বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলছে তা ভেস্তে যাবে। সিপিএম-এর কংগ্রেস-প্রীতিকে লিবারেশনের মতো দল যে ভাল চোখে দেখছে না তা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন লিবারেশন নেতৃত্ব। লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কংগ্রেসের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিন বামপন্থার পুণর্জাগরণ হবে না।’’
আপাতত বাম ঐক্য দূরঅস্ত্!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy