Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
বাড়ি-১

তালহার ছবি দেখে চমকে উঠেছে ডাঙাপাড়া

উৎসব-অনুষ্ঠানে বাড়ির বাসিন্দাদের সম্ভাষণ জানাতে ভিতরে ঢোকা যাবে না। বাড়ির পাঁচিল টপকে পাড়ার বাচ্চাদের বল পড়লে, তা তুলতে যাওয়া যাবে না। বাড়ির লোকগুলোর এমন রকমসকমে খটকা লাগলেও, সন্দেহ তেমন হয়নি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তালহা শেখের ছবিটি দেখে চমকে উঠেছে নদিয়ার কালীগঞ্জের ডাঙাপাড়া। ‘অদ্ভুত’ বাড়ির যে বাসিন্দাকে এত দিন দেখা যেত সাইকেলের ক্যারিয়ারে ব্যাগ ঝুলিয়ে পাউরুটি, কেক, লজেন্স বিক্রি করতে, সেই লোকটির জন্য কি না পুরস্কারমূল্য দশ লক্ষ টাকা!

মনিরুল শেখ ও গৌরব বিশ্বাস
কালীগঞ্জ ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৫
Share: Save:

উৎসব-অনুষ্ঠানে বাড়ির বাসিন্দাদের সম্ভাষণ জানাতে ভিতরে ঢোকা যাবে না। বাড়ির পাঁচিল টপকে পাড়ার বাচ্চাদের বল পড়লে, তা তুলতে যাওয়া যাবে না। বাড়ির লোকগুলোর এমন রকমসকমে খটকা লাগলেও, সন্দেহ তেমন হয়নি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তালহা শেখের ছবিটি দেখে চমকে উঠেছে নদিয়ার কালীগঞ্জের ডাঙাপাড়া। ‘অদ্ভুত’ বাড়ির যে বাসিন্দাকে এত দিন দেখা যেত সাইকেলের ক্যারিয়ারে ব্যাগ ঝুলিয়ে পাউরুটি, কেক, লজেন্স বিক্রি করতে, সেই লোকটির জন্য কি না পুরস্কারমূল্য দশ লক্ষ টাকা!

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, “এই তালহাই তো গত বছর দু’য়েক ধরে গ্রামে গ্রামে ফিরি করে বেড়াত। বলত, বাড়ি মুর্শিদাবাদে। ব্যবসার জন্য এখানে আছে। পাশের গ্রাম মির্জাপুরের গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে ভাল খাতিরও ছিল। ওর জমিতেই তো বাড়ি করে থাকত তালহা। টিভিতে ও খবরের কাগজে ছবি দেখে আমরা তো চমকে উঠেছি।”

বছর দুয়েক আগে মেরেকেটে দু’শতক জায়গার উপরে হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছিল সাদামাটা বাড়িটি। তার পাঁচিল প্রায় আট ফুট উঁচু। আর সেই বাড়ির বাসিন্দাদের চালচলন দেখে গ্রামবাসীদের যে সন্দেহ হয়নি এমনটাও নয়। কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি কেউই। তবে সন্দেহের মাত্রা আরও বাড়ে যখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে রাতারাতি বাড়ির টালি ও করোগেটেড টিন খুলে রেখে উধাও হয়ে যায় তালহা-সহ বাড়ির বাসিন্দারা। ওই ঘটনার দিনকয়েক পরেই বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ঘটে। তোলপাড় হয় রাজ্য। এখন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) তালহা শেখের নামে দশ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করার পরে দুইয়ে-দুইয়ে চার করছে ডাঙাপাড়া।

খাগড়াগড়ের সূত্র ধরে একে একে উঠে এসেছে বর্ধমানের বেশ কয়েকটি এলাকা-সহ মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, মকিমনগর, নবগ্রাম ও নদিয়ার করিমপুর, থানারপাড়া। কিন্তু আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা তালহার সঙ্গে এই ডাঙাপাড়ার যোগটা কী? স্থানীয় সূত্রের খবর, ডাঙাপাড়ার যে জমির উপরে তালহা বাড়ি করেছিল সেই জমিটি ডাঙাপাড়ার পাশের গ্রাম মির্জাপুরের গিয়াসউদ্দিন মুন্সির। প্রায় বারো বছর আগে দেবগ্রামের বাসিন্দা দুই ভাইয়ের কাছ থেকে গিয়াসউদ্দিন ডাঙাপাড়ার ওই জমিটি কিনেছিল। বছর দু’য়েক আগে ওই জমির উপরেই টিনের পাঁচিল ও টালি দিয়ে বাড়ি তৈরি করে তালহা।

গত বুধবার সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রের কর্মী গিয়াসউদ্দিনের বাড়িতে হানা দেয় এনআইএ-র দল। কিন্তু তার আগেই চম্পট দেয় সে। শুক্রবার অবশ্য গিয়াসউদ্দিন নিজেই বাড়ি ফিরে আসে। তার পর থেকে দফায় দফায় গোয়েন্দারা গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলছেন। তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে কোন সূত্রে সে ওই জমিতে ঘাঁটি গাড়তে দিয়েছিল তালহাদের।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই বাড়িতে বাচ্চা-সহ বেশ কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা থাকত। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকেও কিছু অপরিচিত লোকজন আসত। মহিলারা সব সময় বোরখা ব্যবহার করতেন। তারা বাড়ি থেকে বেরোত না। ওই বাড়িতে ঢোকারও কারও হুকুম ছিল না। এমনকী, উৎসবের দিনে ওই বাড়িতে সম্ভাষণ জানাতে গিয়েও মুখঝামটা খেতে হয়েছে বলে দাবি এলাকাবাসীর। তাঁদের অনেকের কথায়, “ভিতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানানো তো দূর, আমাদের শুনতে হয়েছে, ‘কেন এসেছেন এখানে’? অদ্ভুত ওই বাড়ির বাসিন্দারা।”

বাড়িটির পাশেই ছোট, এক টুকরো জমিতে ক্রিকেট খেলে এলাকার বাচ্চারা। তাদের অনেকের দাবি, যত বার পাঁচিল টপকে ওই বাড়িতে বল পড়েছে, তাদের ভিতরে ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। পাঁচিল টপকাতেও নিষেধ করা হয়েছে। বল পড়ার পরে দরজার কড়া নাড়তে হতো। ভিতর থেকে কেউ না কেউ দরজাটা সামান্য ফাঁক করে বলটা বাইরে ছুড়ে দিত।

শনিবার দেখা গেল, বাড়িটির ছাদের টালি খুলে ডাঁই করে রাখা হয়েছে। টিন-টালির স্তূপের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইলেকট্রিকের তার, পেরেক। এক কোণে পড়ে রয়েছে বাচ্চাদের ছেঁড়া একজোড়া চটি, দুটি বস্তা ভর্তি জামাকাপড়। শৌচাগারের দরজার সামনে পড়ে রয়েছে মেয়েদের পোশাক।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণে গোয়েন্দাদের রেডারে রয়েছে বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের বেশ কয়েকটি অননুমোদিত মাদ্রাসা। তারই একটি মুর্শিদাবাদের ঘোড়ামারা মাদ্রাসার সঙ্গে তালহার একটা যোগাযোগ ছিল বলেও গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে গোয়েন্দারা তালহা সম্পর্কে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করছেন।

তালহার মতোই এনআইএ পুরস্কার ঘোষণা করেছে আমজাদ আলি শেখের জন্যও। বীরভূমের কীর্ণাহারের এই যুবক কাজ করত কলকাতার শেক্সপিয়ার সরণির একটি সংস্থায়, যেটি চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করে। গোয়েন্দাদের দাবি, বিস্ফোরক তৈরিতে সহায়ক প্রচুর রাসায়নিক বাগুইআটির কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে খাগড়াগড়ের কুশীলবদের কাছে সরবরাহ করেছিল এই আমজাদ। এ দিন তার বাবা শুকুর শেখ বলেন, “আর এই মানসিক চাপ নিতে পারছি না। ছেলে যদি প্রকৃতই দোষী হয়, তবে তার যা সাজা হওয়ার হোক। তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই।”

অন্য দিকে, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে শনিবার বর্ধমানের সরাইটিকর পঞ্চায়েতের শান্তিপাড়া এলাকায় একটি লোহার কড়াই তৈরি কারখানায় তল্লাশি চালাল এনআইএ। তাদের সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল। এনআইএ সূত্রে খবর, বিস্ফোরণে আহত আব্দুল হাকিম ওই কারখানায় শ্রমিকের কাজ করত। ওই কারখানার মালিক শেখ লাল্টু বলেন, “ধৃত হাকিম এখানে ১০-১২দিন কাজ করেছিল। দৈনিক মজুরি ছিল ১০০ টাকা।

তবে বিস্ফোরণের দিন কয়েক আগে থেকেই হাকিম কারখানায় আসছিল না।” গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, আসাদুল নামের এক জনের সুবাদে হাকিম ওই কারখানায় কাজ পেয়েছিল। আসাদুলের মেয়ে বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ার সেই মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন, যেখানে প্রমীলা জঙ্গিদের জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE