Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মা-বাবার মামলায় শিশুর কান্না হাইকোর্টে

লাল-সবুজ স্কার্ট পরা বছর ছ’য়েকের ফুটফুটে একটি মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। এজলাসের বাইরে, কলকাতা হাইকোর্টের দোতলার বারান্দায়। এক মহিলা আর এক যুবক রীতিমতো টানাটানি করছেন তার হাত ধরে।

শমীক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

লাল-সবুজ স্কার্ট পরা বছর ছ’‌য়েকের ফুটফুটে একটি মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। এজলাসের বাইরে, কলকাতা হাইকোর্টের দোতলার বারান্দায়। এক মহিলা আর এক যুবক রীতিমতো টানাটানি করছেন তার হাত ধরে। অন্য এক যুবক শিশুটিকে বলছেন, ‘‘এক দিনের জন্য মায়ের কাছে যাও।’’ কিন্তু ওই যুবক আর এক প্রৌঢ়াকে প্রাণপণে আঁকড়ে মেয়েটি হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে আর বলছে, ‘‘আমি মায়ের কাছে কিছুতেই যাব না। আমি বাবার কাছেই থাকব।’’

মঙ্গলবার দুপুরে বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের এজলাসের বাইরে এই দৃশ্য চোখ টেনে নেয় আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের। কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী জানান, যে-মহিলা ও যুবক ছোট মেয়েটির হাত ধরে টানছিলেন, তাঁরা হলেন মেয়েটির মা ও মামা। আর মেয়েটি যে-যুবক ও প্রৌঢ়ার হাত ধরে ছিল, তাঁরা হলেন তার বাবা ও ঠাকুরমা।

মেয়েটি কাঁদছিল কেন?

আইনজীবীরা জানান, মেয়েটিকে এক দিনের জন্য তার মায়ের কাছে রাখার নির্দেশ দেন বিচারপতি বাগ। সেই সঙ্গে মেয়েটির বাবাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, বুধবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে তিনি তাঁর আমোদপুরের বাড়িতে ফিরে যাবেন। ফের সংসার শুরু করবেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ ছোট্ট মেয়েটিকে মানাতে পারছে না কেউ। কোনও মতেই মায়ের সঙ্গে যেতে রাজি নয় সে। তাই আদালতের অলিন্দেই কান্না।

মামলাটা কী?

পুলিশ জানায়, বীরভূমের আমোদপুরের বাসিন্দা, ৩২ বছরের ওই যুবক বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মী। ২০০৮ সালে দুবরাজপুরের বাসিন্দা, ২৫ বছর বয়সি এক মহিলার বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পরে তাঁরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মী আবাসনে থাকতেন। পরের বছর তাঁদের একটি মেয়ে হয়। ওই যুবক ২০১৪ সালে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত থাকার অভিযোগ জানিয়ে সিউড়ি আদালতে মামলা করেন। স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ-নির্যাতন ও পারিবারিক হিংসার মামলা দায়ের করেন ওই মহিলাও। পুলিশ জানায়, মহিলা তার পরেই বাপের বাড়ি চলে যান। আর ওই যুবক মেয়েকে নিয়ে ফিরে যান আমোদপুরের বাড়িতে।

পুলিশ জানায়, পারিবারিক হিংসা সংক্রান্ত মামলায় সিউড়ি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রায় দেন, মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত শিশুটি বাবার কাছে থাকবে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যুবকের স্ত্রী বীরভূম জেলা আদালতে মামলা করেন। আদালতে স্ত্রীর আবেদন, তিনি মেয়েকে তাঁর হেফাজতেই রাখতে চান। জেলা আদালত মায়ের আবেদন মঞ্জুর করে।

পুলিশ জানায়, জেলা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ১ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের আদালতে মামলা করেন মহিলার স্বামী। সোমবার মামলাটি ওঠে। স্বামীর আইনজীবী উদয়শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় আদালতে জানান, শিশুটি ১৪ মাসেরও বেশি তার বাবা, ঠাকুরমা ও ঠাকুরদার কাছে রয়েছে‌। সে তার মায়ের কাছে যেতে চাইছে না। সরকারি আইনজীবী জহরলাল দে আদালতে জানান, তিনিও চান, ওই দম্পতি নিজেরাই বিষয়টি মিটিয়ে নিন। বিচারপতি তখন দম্পতিকে জানান, তাঁরা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে হাইকোর্টের ফুড পার্কে খাওয়াদাওয়া করুন। সেই সঙ্গে চিন্তাভাবনা করে দেখুন, কী ভাবে বিষয়টি মেটানো য়ায়। বিকেলে তিনি রায় দেবেন। বিকেলে বিচারপতি নিজের চেম্বারে ওই যুবক ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলেন। পরে রায় দেন, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ওই যুবক তাঁর আমোদপুরের বাড়িতে ফিরে যাবেন।

আইনজীবী উদয়বাবু জানান, স্ত্রী রায় শোনার পরে আদালতের বাইরে বলেন, তিনি আমোদপুর ফিরে যাবেন না। তা শুনে দু’পক্ষের আইনজীবীরা ওই দিনই পুনরায় বিচারপতি বাগের আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিচারপতি বাগ জানিয়ে দেন, তিনি মঙ্গলবার রায় সংশোধন করবেন।

এ দিন মামলাটি ফের ওঠে। বিচারপতি বাগ নির্দেশ দেন, মা শিশুটিকে নিয়ে এক রাত তাঁর বাপের বাড়িতে থাকুন। বুধবার তাঁর স্বামী শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আমোদপুরে ফিরে যাবেন।

বেলা পৌনে ১২টায় বিচারপতির নির্দেশ শুনে দম্পতি আদালত কক্ষের বাইরে আসেন। বিস্কুটের প্যাকেট হাতে বেরিয়ে আসে শিশুটিও। তার পরেই আদালতের নির্দেশ বলবৎ করতে যান মেয়েটির মা ও মামা। এবং তখনই বিপত্তি। মেয়ে যেতে না-চাওয়ায় মা শেষ পর্যন্ত তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বীরভূম ফিরে যান বলে পুলিশ জানায়।

কেন তাঁর সন্তান তাঁর কাছে ফিরে যেতে চাইছে না, ওই মহিলার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মহিলা জানান, তিনি এই বিষয়ে কোনও কথা বলবেন না। মেয়েটির বাবা এ দিন বিকেলে জানান, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘চলো, ঝগড়াঝাঁটি ভুলে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ফের সংসার করি।’ কিন্তু তাঁর স্ত্রী রাজি হননি। ‘‘মেয়েও আমার কাছ থেকে মায়ের কাছে যেতে চাইছে না। দুপুরের পরে আমার স্ত্রী বাপের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আদালত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কী করব, বুঝতে পারছি না,’’ অসহায় শোনাল যুবকের গলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE