বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার প্রতারণা বন্ধ করার লক্ষ্যে বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন মিলেছে কি না, সেই প্রশ্নেই এ বার নতুন বিতর্ক দেখা দিল। সরকারের বিরুদ্ধে বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ আনল বিরোধীরা।
বিধানসভার চলতি অধিবেশনে গত ১১ মে-র বুলেটিনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ইন্টারেস্ট অফ ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্টাব্লিশমেন্ট বিল, ২০১৩’ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়েছে। তার প্রেক্ষিতেই বৃহ়স্পতিবার বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিল, অনুমোদন পেয়ে গেলে বিলটিকে আইনে পরিণত করতে উদ্যোগী হচ্ছে না কেন রাজ্য সরকার? তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেই সম্মতি-বিতর্ক নতুন রূপ পেল বিধানসভায়। সরকার পক্ষের ব্যাখ্যা শুনে বিরোধীদের অভিযোগ, অর্থলগ্নি সংস্থায় প্রতারণার ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি নিয়ে শাসক দলের অন্দরে দ্বিমত আছে বলেই বিলটি নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে!
ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এ দিন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই বিলের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বিলে অনুমোদন দিয়েছেন। তবে
কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক জরিমানার বিনিময়ে দোষীদের কারাদণ্ড লাঘব করার যে সংস্থান বিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে, তা তাঁরা মানবেন না। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে এই মর্মে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে রাজ্য সরকার অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) জারি করে নিজেদের আইন চালু করে দেবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানান। এতেই তীব্র আপত্তি তোলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর বক্তব্য, একে তো পাশ হয়ে যাওয়া বিল আবার অধ্যাদেশ হয় না! তার উপরে বিধানসভায় পেশ হওয়া নথিতে কোথাও রাষ্ট্রপতির শর্তসাপেক্ষ অনুমোদনের কথা বলা নেই। বিরোধী বিধায়কেরা হইচই করছেন দেখে মুখ্যমন্ত্রী এ বার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে অনুরোধ করেন বিষয়টি স্পষ্ট করে দিতে।
অর্থমন্ত্রী জানান, বিলে অনুমোদনের শর্তের চিঠি পরে এসেছে। ততক্ষণে বিধানসভার নথিতে অনুমোদনের কথা বলা হয়ে গিয়েছে! মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের রেশ ধরেই অর্থমন্ত্রী আরও জানান, তামিলনাড়ুর একটি আইনের আদলে আর্থিক জরিমানার বিনিময়ে প্রতারণায় দোষীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাঘব করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজ্য চায়, বিলে যথাসম্ভব ক়ড়া শাস্তির ব্যবস্থাই থাকুক। অমিতবাবুর এই ব্যাখ্যা শুনেও ফের উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলেন সূর্যবাবু। বিরোধী দলনেতা দাবি করেন, তার মানে তো রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আসলে আসেনি! অনুমোদন আগে এসেছে, পরে শর্তের কথা জানা গিয়েছে— এ কী করে সম্ভব? এমন গুরুতর বিষয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে বলে তিনি স্পিকারের রুলিং দাবি করেন।
স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রুলিং দিয়ে এর পর বলেন, রাজ্যপালের দফতর থেকে বিধানসভায় যা তথ্য এসেছে, তা-ই বুলেটিনে ছাপানো হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে কী মত বিনিময় হয়েছে, তা বিধানসভার গোচরে নেই। স্পিকারের বক্তব্য
শুনে আরও হইচই শুরু করে বিরোধীরা। এরই মধ্যে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব প্রশ্ন তোলেন, মুখ্যমন্ত্রীই জানিয়েছিলেন এই অধিবেশনে অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত একটি বেসরকারি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। কবে হবে সেই আলোচনা? মুখ্যমন্ত্রী জানান, সরকারের কোনও আপত্তি নেই আলোচনায়। সূর্যবাবু সোহরাবকে সমর্থন করে বলেন, কিন্তু আগের দিনই এই সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব আলোচনা না হয়ে
খারিজ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় স্পিকার জানান, কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে ফের আলোচনা করে ওই প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
গোটা ঘটনাপ্রবাহে বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য আড়ালেরই অভিযোগ আনছে। পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেন, ‘‘বুলেটিনে যা লেখা হয়েছে আর এ দিন সভায় যত রকম কথা বলা হল, তাতে বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। পরস্পর-বিরোধী কথা বলা হচ্ছে! কোনটা ঠিক, আমরা জানতে চাই।’’ অতীতে তাঁদের ৩৪ বছরের সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন কথাটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব! যা
হয় না। হয় রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন। নয়তো তাঁর দফতর থেকে রাজ্যকে জানানো হয়েছে, শর্ত মানলে তবেই সম্মতি মিলবে। নথিপত্র না দেখলে সত্যিটা বোঝা যাচ্ছে না!’’ তাঁর আরও কটাক্ষ, ‘‘সারদা-কাণ্ডে জেলে থাকা এক মন্ত্রী এখন ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন বলে সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে। তিনি নিশ্চয়ই চান, কারাদণ্ড লাঘব হোক! সরকার এবং শাসক দলের মধ্যে চাপ রয়েছে বলেই নানা রকম কথা বলে এই বিলকে আইনে পরিণত করা হচ্ছে না!’’ রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে এত বিভ্রান্তি কেন তৈরি করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy