পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলমহলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে বড় ধরনের হামলা চালানোর ছক কষেছে মাওবাদীরা, এবং সেটা হতে পারে এ সপ্তাহেই— সোমবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের এই সতর্কবার্তা এসে পৌঁছেছে নবান্নে। আর তার পরেই নড়াচড়া শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য প্রশাসনে। দিল্লি যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন সতর্কবার্তার কথা। নবান্নের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা যাতায়াত করছে, এমন খবর ছিলই। কিন্তু তারা যে থানা বা সিআরপিএফ ক্যাম্পের উপরে হামলা চালানোর চেষ্টা করছে, সেটা যথেষ্ট আতঙ্কের!
নির্দিষ্ট সূত্র মারফত মাওবাদীদের এই হামলা চালানোর ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বামপন্থী জঙ্গি কার্যকলাপ রোধ শাখা। তার ভিত্তিতেই নবান্নকে এই সতর্কবার্তা পাঠায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ। সেখানে মুখ্যসচিব ও পুলিশ প্রধানকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও বলা হয়। নবান্নের খবর, বার্তাটি পাওয়ার পরেই স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের প্রধান জিএমপি রেড্ডি দীর্ঘ বৈঠক করেন। সেখানে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। তার পরে পশ্চিমাঞ্চলের চারটি জেলার পুলিশ-প্রশাসনকে সর্তক করার পাশাপাশি যৌথ বাহিনীকেও তৎপর থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। দিল্লি যাওয়ার সময় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের কাছে খবর এসেছে, ১৫ অগস্টের আগে কিছু উগ্রপন্থী সংগঠন অশান্তি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন লোকের সাহায্যে মাল-মেটিরিয়াল সংগ্রহ করছে। একটি রাজনৈতিক দলের কথা আইবি-র রিপোর্টে রয়েছে। আমরাও সতর্ক রয়েছি।’’ প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘মাওবাদী হামলা সংক্রান্ত কিছু নির্দিষ্ট তথ্য আমরা পেয়েছি। প্রাথমিক ভাবে পশ্চিমাঞ্চলে মাওবাদীদের গতিবিধিও টের পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কিছু ঘটার আগেই যাতে তা ঠেকানো যায়, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে কিন্তু জঙ্গলমহলে দ্রুত পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। বাম জমানায় যে লালগড় আন্দোলনে সমানে খুন-জখম-অপহরণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলা চলছিল, পরিবর্তনের পরে কিষেনজির মৃত্যু এবং সুচিত্রা মাহাতো ও জাগরী বাস্কের মতো প্রথম সারির নেত্রীদের আত্মসমর্পণের পরে তা দ্রুত থিতিয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী তখন দাবি করেন, জঙ্গলমহল হাসছে। কেন্দ্রের অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকায় কিছু কাজও শুরু হয়। ২ টাকা কেজির চাল দেওয়া থেকে জুনিয়র হোমগার্ড ও পুলিশে নিয়োগ পর্যন্ত হয়েছে এই সময়ের মধ্যে।
জঙ্গলমহল যে এর মধ্যেও ক্রমে ভিতরে ভিতরে অশান্ত হয়ে উঠছে, সেটা কিন্তু সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় আঁচ করা যাচ্ছিল। বিশেষ করে কিষেনজিকে হত্যা করা নিয়ে যে মন্তব্য করেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তার বিরুদ্ধে সমানে পোস্টার পড়তে শুরু করে। সেখানে মাওবাদীরা পাল্টা আঘাতের ইঙ্গিতও দেয়। রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের প্রাথমিক ধারণা, বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘটলেও এর পিছনে কোনও মাথা কাজ করতে পারে।
এর পরে নতুন করে মাওবাদী তৎপরতা শুরু হতে পারে আন্দাজ করেই গত চার-পাঁচ দিনে আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত পরপর দু’বার ঝাড়গ্রামে গিয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। মাওবাদীরা যে জঙ্গলমহলে যাতায়াত বন্ধ করেনি, আইবি সেই সংক্রান্ত রিপোর্টও দিয়েছে রাজ্যকে। নবান্নের এক কর্তা সে কথা উল্লেখ করে জানান, কিন্তু যাতায়াত করা আর স্থায়ী ভাবে ঘাঁটি গেড়ে হামলার ছক করা এক কথা নয়। সিদ্ধিনাথ এ দিন দীর্ঘ সময় ঝাড়গ্রামে ছিলেন। প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে তাঁর কাছে নির্দেশ যায়। তিনি যৌথবাহিনীর সঙ্গে কথা তাদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশও দেন এর পরে।
কী বার্তা এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে?
নবান্ন সূত্রের খবর, কেন্দ্রের ওই সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, মাওবাদীদের ৬০ জনের একটি দল জঙ্গলমহলে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। তারা ১৫ অগস্টের মধ্যে যে কোনও সময়ে জঙ্গলমহলের কোনও পুলিশ বা সিআরপি ক্যাম্পে হামলা চালাতে পারে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা নির্দিষ্ট ‘সোর্স’ মারফত জেনেছেন, গত ২ অগস্ট রাতে ঝাড়খণ্ডের গুরাবান্দা গ্রামে এক গ্রামবাসীর বাড়িতে মাওবাদীরা জঙ্গলমহল আক্রমণের কৌশল ঠিক করতে বৈঠক করে। সেই বৈঠকে আকাশ, জয়ন্ত ওরফে সুসরাজ, রঞ্জিত পাল, সেপাই টুডু, কানু টুডুরা হাজির ছিলেন। সেখানেই মাওবাদী নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন, কিষেনজির মৃত্যুর বদলা নিতে এ বার বাংলাতেই বড় ধরনের হামলা চালাবেন তাঁরা। ঠিক হয়, প্রথম নিশানা হবে বেলপাহাড়ি। এ জন্য তাঁরা ঝাড়খণ্ড থেকে বেলপাহাড়ির কোদাপুরা দিয়ে বাংলায় ঢুকবে। কোদাপুরা বেলপাহাড়ির শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে পড়ে। কেন্দ্রের বার্তা থেকে জানা গিয়েছে, ৩ অগস্ট গুরাবান্দা থেকে ৬০ জনের ওই দলটি পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া ঘাটশিলায় এসে পৌঁছয়। যে কোনও সময় তারা বেলপাহাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে।
গুরাবান্দার এই বৈঠকের কথা পশ্চিম মেদিনীপুরের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি)-ও তাদের নজরদারি ব্যবস্থার সাহায্যে জানতে পেরেছে। তাদের কাছেও খবর, মাওবাদীদের আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য বেলপাহাড়ির কোনও পুলিশ ফাঁড়ি। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘ওদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা আমরা আগাম জানতে পেরেছি। ফলে জঙ্গলমহলে ৪৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। চেষ্টা হচ্ছে, যাতে এ রাজ্যে ঢুকলেই ওই মাওবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’ রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসের সময় দিল্লি থেকে বরাবর বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার নির্দেশ আসে। এ বার তেমন নির্দেশ আগেই এসেছে। কিন্তু সোমবার নর্থ ব্লক যে ধরনের নির্দিষ্ট তথ্য সহযোগে মাওবাদীদের আগাম পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌথ বাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’’
কিন্তু থানা বা সিআরপি ক্যাম্পকেই কেন প্রথমে নিশানা করা হবে? কেন্দ্রের বার্তায় বলা হয়েছে, ২ অগস্টের বৈঠকে কয়েক জন মাওবাদী নেতা জানান, ছত্তীসগঢ় এবং ঝাড়খণ্ড থেকে বেশ কয়েক জন যুবক-যুবতী স্কোয়াডে যোগ দেওয়ায় তাঁদের শক্তি বেড়েছে। এই স্কোয়াডের জন্য আরও বেশি পরিমাণ অস্ত্র এবং গোলাবারুদ প্রয়োজন। সে জন্যই এক বা একাধিক পুলিশ বা সিআরপিএফ ক্যাম্পে হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের আরও বক্তব্য, নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলা মাওবাদীদের পুরনো ছক। এর আগে ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জঙ্গলমহলের শিলদায় ইএফআর শিবিরে হানা দেয় মাওবাদীরা। এই ঘটনায় ২৪ জন জওয়ান প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ লুঠ করা হয়েছিল।
‘শান্ত’ জঙ্গলমহল আবার কেন অশান্ত হচ্ছে? প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, এর পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। এক, মাওবাদীরা কিষেনজির মৃত্যুর ‘প্রতিশোধ’ নিতে চায়। সে জন্যই বড় হামলার প্রস্তুতি। দুই, ছত্রধরের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় এলাকায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই জঙ্গলমহলে পায়ের তলায় মাটি খুঁজছে মাওবাদীরা। সে জন্যই তাদের যাতায়াত বেড়েছে। ক্রমে শক্তি বাড়িয়ে এখন তারা নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলা চালানোর ছক কষছে। তাতে সফল হলে ফের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ফেলতে পারে তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy