Advertisement
০১ মে ২০২৪

নোট-যন্ত্রণায় ভুগছে আলুর বর্তমান-ভবিষ্যৎ

নোট বাতিলের ধাক্কা এ বার আলুতে। সেই ধাক্কা এতটাই, তা খেত থেকে হিমঘর— সব ক্ষেত্রকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

নোট বাতিলের ধাক্কা এ বার আলুতে।

সেই ধাক্কা এতটাই, তা খেত থেকে হিমঘর— সব ক্ষেত্রকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এর জেরে আর কয়েক দিনের মধ্যে বাজারে আলুর জোগান কমা এবং দাম বাড়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনই আগামী মরসুমে আলুর উৎপাদন নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কেননা, নগদ টাকার অভাবে একদিকে হিমঘর থেকে সে ভাবে আলু বের করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা অন্য দিকে, গ্রামবাংলার অনেক চাষি এখনও আলু বসাতে পারেননি। বিঘের পর বিঘে ফাঁকা পড়ে রয়েছে আলু চাষের জমি! অর্থাৎ, বর্তমানের সঙ্গে প্রশ্ন আলুর ভবিষ্যৎ নিয়েও।

সরকারি নির্দেশ মতো চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে রাজ্যের সব হিমঘর খালি করার কথা। অথচ, রাজ্যের ৪৮০টি হিমঘরে এখনও মজুত আলুর পরিমাণ অন্তত ১৪ লক্ষ টন। নগদের অভাবে ভুগতে থাকা আলু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হিমঘরের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন এখন কার্যত বন্ধ। সে ভাবে আলু বের করা হচ্ছে না। কারণ, হিমঘর থেকে এক বস্তা (৫০ কেজি) আলু বের করতে অন্তত ৯০ টাকা (হিমঘর ভাড়া ৭৮ টাকা এবং মুটে-বাছনদার খরচ ১২ টাকা) লাগে। অর্থাৎ, ১০০ বস্তা আলুর জন্য খরচ ৯০০০ টাকা। কিন্তু ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় হিমঘর-মালিকেরা তা নিচ্ছেন না। আর ১০০ টাকার অত নোট পেতে তাঁদের কালঘাম ছুটছে।

বর্তমানে বাজারে এক কেজি চন্দ্রমুখী আলু বিকোচ্ছে ২৪-২৬ টাকা দরে। নগদের অভাব এ ভাবে চলতে থাকলে বাজারে আলুর জোগান কমা এবং দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। সমস্যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বৈঠকে বসেছে আলু ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি। রাজ্য সরকারের
দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছে তারা। কেউ কেউ হিমঘরে আলু
রাখার মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়ানোর পক্ষেও সওয়াল করছেন।
রাজ্যের আলু ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন, ‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র নেতা লালু মুখোপাধ্যায় জানান, কৃষি বিপণনমন্ত্রী তপন দাশগুপ্তের মাধ্যমে তাঁরা সমস্যার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাবেন। লালুবাবু বলেন, ‘‘নগদের যে হাহাকার চলছে, তা এখনই বদলাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের ব্যবসা কার্যত বন্ধের মুখে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব হিমঘর খালি করা সম্ভব নয়।” হুগলির তারকেশ্বর এ রাজ্যের অন্যতম বড় আলুর আড়ত। ওই এলাকার আলু ব্যবসায়ী অনিল সামন্ত বলেন, ‘‘নগদের যা হাল, তাতে আলু ব্যবসা লাটে ওঠার পরিস্থিতি। ধারে কতদিন কারবার চলবে?’’ তারকেশ্বরেরই আর এক আলু ব্যবসায়ী রাম মিত্র বলেন, ‘‘যা অবস্থা, টেনেটুনে আর দিনকয়েক হয়তো চলবে। কিন্তু তার পরে বাজারে আলুর জোগান স্বাভাবিক রাখা কঠিন। দামও বাড়তে পারে।’’

আলু-শঙ্কা

হিমঘর থেকে আলু বের করা না গেলে বাজারে জোগান কমবে। ফলে, বাড়তে পারে দাম।

নগদের অভাবে চাষিরা আলুবীজ কিনতে পারছেন না।

দেরিতে আলু চাষ শুরু হলে কমবে ফলন।

উৎপাদন কমলে আগামী মরসুমে আলুর দাম বাড়ার সম্ভাবনা।

টাকার অভাবে বিপর্যয়ের মুখে আলুর ভবিষ্যৎও। কেননা, নভেম্বরের গোড়া থেকে ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে খেতে আলু বসানোর কাজ শেষ হয়ে যায়। অথচ, গ্রামবাংলার অনেক চাষি এখনও আলু বসাতে পারেননি। কৃষি দফতরও মানছে, ৫০০ এবং হাজার টাকার নোট বাতিলের পর অনেক চাষির হাতে টাকা নেই। অথচ, জমি চাষযোগ্য করা থেকে আলুর বীজ, সার কেনা এবং মজুরি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন যে খরচ হয়, তা অনেক চাষি জোগাড় করতে পারছেন না। ফলে, চাষে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্য সরকারও। এমন অবস্থা বেশিদিন চললে চাষিদের মাথায় যে বাজ পড়বে, মানছে কৃষি দফতর। দাম নিয়ে ক্রেতারাও স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘অর্থের অভাবে অনেক চাষি আলু বসানো শুরু করতে পারছেন না। এতে উৎপাদন কমে গিয়ে আগামী মরসুমে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হতে পারে। বেড়ে যেতে পারে আলুর দামও। মানও সঠিক থাকবে না।’’

চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে অন্তত ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। তার মধ্যে সার, মজুরি বাবদ যায় প্রায় ১১ হাজার টাকা। কিন্তু নোট বাতিলের ধাক্কায় একসঙ্গে অত টাকা জোগাড় করতে তাঁরা হিমসিম খাচ্ছেন। হুগলির পুড়শুড়ার কেলেপাড়া এলাকার প্রশান্ত ধোলে এ বার আলু চাষের কাজ শুরুই করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘কৃষি সমবায় থেকে শুধু সারটা তুলেছি। কিন্তু বীজ কিনব কী করে? টাকা নেই। খেতমজুরদের টাকা দিতে পারছি না। ৫০০, ১০০০ টাকার নোট কেউ নিচ্ছে না।’’ কৃষি দফতরের আধিকারিকরাও মানছেন, পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের আলুবীজ নগদের অভাবে কিনতে পারছেন না অনেক চাষি।

অতঃকিম? রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপবাবু জানান, ইতিমধ্যেই সরকারি ভাবে আলোচনাও হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যসচিব। কিন্তু সবটাই তো কেন্দ্র সরকারের হাতে। তাই তাদের দিকেই আপাতত তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation business of potato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE