Advertisement
০৬ মে ২০২৪
নোটের বাংলা

তা হলে ‘মেনুর’ কী হবে! নোটের জ্বালা সয়েও ভোটে রইল ‘টিফিন’

কোথাও মুড়ি আসে, গত বারের মতো পাউরুটি আসে না। কোথাও নোটের লাইন ছেড়ে ভোটের লাইনে লোক আসে না। তাই কষ্ট করেও সেখানে গত বারের মুড়ির বদলে এ বার লুচি আসে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩১
Share: Save:

কোথাও মুড়ি আসে, গত বারের মতো পাউরুটি আসে না। কোথাও নোটের লাইন ছেড়ে ভোটের লাইনে লোক আসে না। তাই কষ্ট করেও সেখানে গত বারের মুড়ির বদলে এ বার লুচি আসে।

মোদ্দা কথাটা হল— ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে নোট আসে না! হোক না উপনির্বাচন। হোক না ফলাফল নিয়ে কোনও কোনও শিবিরে কিঞ্চিৎ আত্মবিশ্বাস। তবু গ্রামের নেতার মনে খচখচে অস্বস্তি রেখে যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর দিন দশেক আগেকার ঘোষণা।

নোট তো নেই। তা হলে ‘মেনুর’ কী হবে!

এ মেনু ভোটের মেনু। তারও আবার রকমফের আছে। এক, বাঁধা ভোটারের জন্য। দুই, দলের ছেলেদের জন্য। এবং তিন, এটিএমের লাইনে দাঁড়ানো জনতাকে বুথমুখী করার জন্য। আর শুধু ‘টিফিন’ জোগাড় করলেই তো হল না, নোটের আকালে তার দাম মেটানোও আর এক যন্ত্রণা!

অতএব শনিবার উপনির্বাচনের দিন বিস্তর মাথা খাটাতে হল রাজ্যের শাসক দলের বহু নেতাকে। কোচবিহার ও তমলুক লোকসভা কেন্দ্র বা বর্ধমানের মন্তেশ্বর বিধানসভা— সর্বত্রই ছবিটা কম-বেশি এক। কোনও নেতার দাবি, খাবারের কথা আগাম ভেবে তিনি ভোটের আগেই বড় নোট ভাঙিয়ে খুচরো করে রেখেছিলেন। কেউ ধার করেছেন। কেউ আবার খাবার আনিয়েছেন ব্যবসায়ীদের ‘অনুরোধ’ করে (বিরোধীরা অবশ্য তাকেই বলছেন ‘হুমকি’)।

গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জঙ্গলমহল থেকে বীরভূম দেখেছিল মুড়ি-রাজনীতি। বর্ধমান গ্রামীণের বেশ কিছু বিধানসভায় যেমন ভোটারদের জন্য ব্যবস্থা হয়েছিল তরমুজ, সরবত, কলা-পাউরুটির। কোথাও কোথাও কচুরি-তরকারি ছিল। এই মন্তেশ্বর বিধানসভারই অনেক জায়গায় ‘আমাদের লোক’ বলে চিহ্নিত ভোটারদের জন্য ছিল তৃণমূলের পাউরুটি-কলা। শনিবার এলাকা চক্কর দিয়ে দেখা গেল, পাউরুটি প্রায় হাওয়া। মন্তেশ্বরের একটা বড় অংশই ফিরেছে মুড়িতে। সঙ্গে কোথাও আলুর চপ, কোথাও ঘুগনি, কোথাও ছোলাসেদ্ধ।

মুড়িতে ফিরলেন কেন? প্রশ্ন তুলতে তৃণমূলের জেলা স্তরের এক নেতা খোলসা করলেন, ‘‘গৌরী সেন তো আর নেই, যে চাইলেই টাকা দেবে! ২০০০-এর নোট গ্রামেগঞ্জে ভাঙানো দুষ্কর। এলাকায় মুড়ি তৈরির কারখানা প্রচুর। সেখান থেকেই ধারে বা চেয়েচিন্তে ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ সূত্রের খবর, এটিএমের লাইনে দাঁড়ানো কিংবা মাঠে
ফসল কাটায় ব্যস্ত জনতাকে দলীয় কর্মীরা আগেভাগেই বলে এসেছেন— ‘ভোট দিন, মুড়ি নিন’।

নাম বলতে চাইলেন না মন্তেশ্বরের দুই তৃণমূল কর্মী। জানালেন, বৃহস্পতিবার রাতে দল থেকে বুথভিত্তিক খরচার (‌ভোটারদের খাবারের খরচ ধরে) জন্য বাতিল নোটে হাজার দুয়েক করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার সেই টাকা পাল্টে খুচরো করার জন্য নানা ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়া হয়েছিল। তার জন্য বুথ স্তরে তিন-চার জনকে নিয়ে এক-একটি ‘দল’ তৈরি করে দিয়েছিলেন স্থানীয় নেতৃত্ব। কিন্তু তাতেও সব টাকা বদল হয়নি। তখন মেমারি ও বর্ধমান সদরের চালকল, পেট্রোল পাম্প এবং ধাবা মালিকদের কাছ থেকে পরিচিতদের মাধ্যমে টাকা খুচরো করানো হয়েছে। তার পরে এসেছে মুড়ি। তারও অনেকটাই ধারে।

কিন্তু নগদের অভাব তো ব্যবসায়ীদেরও। তার পরেও ধার দেওয়া যাচ্ছে? মন্তেশ্বরের এক মুড়ি ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি টাকা দেওয়া হবে, বলেছেন নেতারা। ‘না’ বলতে পারিনি। এখন কপাল!’’ মুড়ির প্যাকেট হাতে অনেক ভোটারই অবশ্য বলেছেন, “প্যাকেট না নিয়ে উপায় নেই। তবে মুড়ি-চপ বা ঘুগনি-মুড়ি খেতে ভালই লাগছে!”

দিনের শেষে মন্তেশ্বরে প্রায় ৮৬ শতাংশ ভোট পড়েছে, গত বিধানসভার তুলনায় প্রায় এক শতাংশ বেশি। বিরোধীদের অভিযোগ, খাবার দিয়ে নয়, ভয় দেখিয়ে তৃণমূল বুথে লোক এনেছে, অবাধ ছাপ্পা দিয়েছে। অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা মহম্মদ ইসমাইল, খাদিম রায়েরা বলছেন, ‘‘ও সব রাখুন। বাড়ন্ত নোটের বাজারেও মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন, এটাই বড় কথা।’’

ভোটারদের জন্য মুড়ি-চপের ‘টিফিন’ ছিল কোচবিহারের অনেক জায়গাতেও। সেখানে দলের কর্মীদের খাওয়ানোর জন্য শহর এলাকায় কিছু হোটেলের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করেছিলেন তৃণমূল নেতারা। সেই মতো বিলি হয়েছে ‘স্লিপ’। সেই ‘স্লিপ’ দেখিয়ে ভবানীগঞ্জ বাজার, পাওয়ার হাউস লাগোয়া এলাকার হোটেলে ডিম-ভাত, মুরগির মাংস-ভাত খেয়েছেন কর্মীরা। পরে নেতার অফিসে স্লিপ জমা দিয়ে হোটেল মালিকের খাবারের দাম ফেরত পাওয়ার কথা। অবশ্য ব্যাপারটা সে ভাবে মানতে চাননি কেউ। তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেছেন, “হাতে টাকাই নেই। খাবারের আয়োজন হবে কোথা থেকে!’’

তবু বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোচবিহার লোকসভায় প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। গত বার যা ছিল ৮৩ শতাংশ। তৃণমূলের নেতাদের যুক্তি, একে উপনির্বাচনে লোকের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবণতা কম থাকে, তার উপরে এ বার নোটের ভোগান্তিতে জেরবার জনতা। তাই বুথমুখো হননি অনেকে।

একই সমস্যার কথা মানছেন তমলুকের কাঁকটিয়া বাজার এলাকার তৃণমূল নেতা, যুব তৃণমূলের ব্লক সভাপতি জয়দেব বর্মন। ওই লোকসভাতেও ভোটের হার কমেছে। গত বার ছিল ৮৮ শতাংশ, এ বার ৮২। জয়দেববাবু বলছেন, ‘‘সকাল-সকাল অনেকে এটিএমে লাইন দেওয়ায় চিন্তায় পড়েছিলাম। অনেকে তো টাকা তুলে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। কর্মীদের পাঠিয়ে তাঁদের বুথে ডেকে আনতে হয়েছে। আমি নিজেও গিয়েছিলাম।’’

নোটের ঘূর্ণি পিচে অবশ্য ‘দুসরা’ ছেড়েছেন সুতাহাটা ব্লকের এক তৃণমূল নেতা। বলেই ফেললেন, ‘‘আগে ঠিক ছিল, নোটের লাইন থেকে ভোটের লাইনে লোক আনলে মুড়ি-চানাচুর খাওয়ানো হবে। কিন্তু তার পরেও ভোটের লাইন বাড়েনি। বাধ্য হয়ে মেনু পাল্টে লুচি-আলুর দম খাওয়ানো হল ভোটারদের।’’

কষ্ট হল। তবু কেষ্ট, থুড়ি ভোট মিললে ক্ষতি কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

By-election Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE