Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

আয়লায় সর্বস্বান্ত সীতা ‘না’ বোতাম টিপবেন এ বার

ঘর নেই। ন’জনের সংসার আর কতদিন মাথাগুঁজে থাকবে ঝুপড়িতে? গৃহিনী তাই নিজেই ঘর বাঁধছেন। একেবারে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, অসুস্থ স্বামী মাটি কাটছেন। আর গৃহিনী সেই মাটি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া কুঁড়েখালি খালের পাশে। ‘ঘর’ তৈরি করছেন তাঁরা। অথচ তাঁদের নামে নাকি এসেছিল সরকারি অনুদান।

কুঁড়েখালি খালের পাশে ঘর বাঁধার কাজে হাত লাগিয়ছেন স্বামী-স্ত্রী।— নিজস্ব চিত্র।

কুঁড়েখালি খালের পাশে ঘর বাঁধার কাজে হাত লাগিয়ছেন স্বামী-স্ত্রী।— নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:২৪
Share: Save:

ঘর নেই। ন’জনের সংসার আর কতদিন মাথাগুঁজে থাকবে ঝুপড়িতে? গৃহিনী তাই নিজেই ঘর বাঁধছেন। একেবারে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, অসুস্থ স্বামী মাটি কাটছেন। আর গৃহিনী সেই মাটি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া কুঁড়েখালি খালের পাশে। ‘ঘর’ তৈরি করছেন তাঁরা।

অথচ তাঁদের নামে নাকি এসেছিল সরকারি অনুদান। আয়লা বিধ্বস্তদের তালিকায় নাম ছিল তারক গায়েন, সীতা গায়েনেরও। পাওয়ার কথা প্রতিবন্ধী ভাতাও। তাঁদের সংসারে ন’জনের মধ্যে কথা বলতে পারেন না পাঁচ জনই। প্রতিবন্ধী কার্ড থাকলেও ভাতা পাননি কেউ। পাঁচ বছর আগে আয়লায় বাড়ি ভেঙেছে। কিন্তু ঘর তৈরির টাকা মেলেনি এখনও।

পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান শ্যামল মণ্ডলের দাবি, “পরিবারটি আয়লার টাকা পেয়েছে। চাল পাচ্ছে। তবে দেরিতে প্রতিবন্ধী কার্ড করানোয় ভাতার টাকা পেতে কিছুটা দেরি হচ্ছে।” কিন্তু গায়েন দম্পতির বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি সাহায্যই পাননি। তাঁরা বলেন, “আয়লার ঘর ভাঙার টাকা মেলেনি। সরকার যদি টাকা দিয়েও থাকে, তা আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছয়নি।”

ভোট দেবেন কি না জানতে চাইলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সীতা। খানিক অবজ্ঞা, খানিক নিস্পৃহতা তাতে। বলেন, “গ্রামের লোক বলছে, এ বারে নাকি একটা ‘না’ ভোটের বোতাম রয়েছে। ওটাতেই টিপ মারব।”

কার্যত নদীর জল আর সুন্দরবনের জঙ্গলের উপর ভরসা করে জীবন কাটছে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের কালীতলা পঞ্চায়েতের ৪ নম্বর সামশেরগঞ্জ গ্রামের প্রতিবন্ধী পরিবারটির। জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেন না তারক গায়েন। স্ত্রী সীতা ও ছেলে শম্ভু কথা বলতে পারলেও মেয়ে শর্মিলা জন্ম থেকে মূক। শ্বশুর, দেওর এবং দেওরের মেয়েও মূক। পরের জমিতে জন খেটে কোনও মতে সংসার চালাচ্ছিলেন তারক-সীতা। বাদ সাধল আয়লা। সীতার কথায়, “আয়লার পরে সর্বস্বান্ত হয়ে যাই। ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে কাজের জন্য কেরলে চলে গেল।” চাষের কাজও মেলে না। এখন ভরসা জঙ্গল। ভোরে উঠে অসুস্থ স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে মাছ বা কাঁকড়া সংগ্রহ করেন সীতা। ফেরার সময়ে জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসেন সেখান থেকে। সরকার নয়, জঙ্গলই এখন আশ্রয়। আর ভরসা মেয়ে শর্মিলা। তার লেখাপড়া এখনও বন্ধ হতে দেননি সীতা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে সে।

খাল শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই জঙ্গল। নাইলনের দড়ির উপর জাল দিয়ে ঘেরা ওই জঙ্গল থেকে মাঝে মধ্যেই বেড়া ডিঙিয়ে গ্রামে ঢোকে বাঘ। ছাগল গরু তো বটেই, এমন কি মানুষ মুখে করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। রয়েছে বিষধর সাপও। কয়েক বছর আগেও বাঘের ভয়ে কুঁড়েখালি খালের ধারে বাস করা তো দূর, ভয়ে খালের ধারে যেতে সাহস করত না কেউ। কিন্তু আয়লা তারক-সীতার মতো গরিবদের বাধ্য করেছে জঙ্গলের পাশে বাস করতে। ভয় পেরিয়ে এসেছেন তাঁরা।

জঙ্গলই যাঁদের আশ্রয়, কাকে ভোট দেবেন তাঁরা? “কাকে ভোট দেব বলতে পারেন? ভোটের আগে সব দলই তো হাত জোড় করে এসে দাঁড়ায়। প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোট ফুরোলে আর দেখা মেলে না।” গ্রামে নির্বাচন কমিশনের প্রচার হয়েছে, কোনও প্রার্থী পছন্দ না হলে ‘না’ ভোটে বোতাম টেপা যাবে। সেই বোতামই এখন ভরসা সীতার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu aayla homeless
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE