Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জল আনতে সঙ্গে মুড়ি-বাতাসা নিয়ে বেরোতে হয় মহিলাদের

পানীয় জলের পাইপ ফাটা, নয় তো ফুটো। তার উপরে আবার জল ধরে রাখার জন্য তৈরি ভ্যাটগুলির অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে সেখানে পানীয় জল ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বার বার সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে কেউ গ্রামবাসীদের আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল দেওয়ার কথা বললে খেপে যান সুন্দরবন এলাকার মানুষ। তারা বলেন, “আর কতো দিন কেবল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে? আমরা মাঠঘাট থেকে জোগাড় করা তীব্র নোনা জল খেয়ে আর পারছি না। হয় পরিস্রুত জলের ব্যবস্থা করুন। না হলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করুন।”

হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলিতে জলের জন্য লাইন।—নিজস্ব চিত্র।

হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলিতে জলের জন্য লাইন।—নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
হিঙ্গলগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০১:০১
Share: Save:

পানীয় জলের পাইপ ফাটা, নয় তো ফুটো। তার উপরে আবার জল ধরে রাখার জন্য তৈরি ভ্যাটগুলির অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে সেখানে পানীয় জল ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বার বার সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে কেউ গ্রামবাসীদের আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল দেওয়ার কথা বললে খেপে যান সুন্দরবন এলাকার মানুষ। তারা বলেন, “আর কতো দিন কেবল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে? আমরা মাঠঘাট থেকে জোগাড় করা তীব্র নোনা জল খেয়ে আর পারছি না। হয় পরিস্রুত জলের ব্যবস্থা করুন। না হলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করুন।”

গরম পড়তেই পানীয় জলের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের দুলদুলি এবং সাহেবখালি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে। দুলদুলি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩ নম্বর সাহেবখালি, মঠবাড়ি, দক্ষিণ দুলদুলি, পশ্চিম দুলদুলি, ২ নম্বর সাহেবখালি এবং সাহেবখালি পঞ্চায়েতের মধ্যে দেউলি, রমাপুর, ৪ নম্বর সাহেবখালি, ৫ নম্বর সাহেবখালি, পুকুরিয়া, চাঁড়ালখালি, কাঁঠালবেড়িয়া-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম এই সমস্যায় ভুগছে। পরিস্রুত জল তো দূরঅস্ৎ, দূরদূরান্ত থেকে এক কলসি জল জোগাড় করে আনতে কয়েক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রাত থাকতে উঠে কলসি নিয়ে ছুটতে হয় কলের লাইনে। তাতেও জল পাওয়ার নিশ্চিয়তা নেই। প্রায় দিনই কলতলায় জল নিতে গিয়ে ঝগড়া-মারামারি, চুলোচুলি বাধছে।

হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের সুন্দরবন এলাকায় পাঁচটি পঞ্চায়েতের মধ্যে দুলদুলি এবং সাহেবখালি অন্যতম। লেবুখালি থেকে সাহেবখালি নদীর পারে প্রথমে পড়ে দুলদুলি পঞ্চায়েত। সেখানকার সাঁতরা গ্রামে একাধিক পাম্প মেশিনের মাধ্যমে ডিপটিউবলের থেকে পানীয় জল তুলে তা পাঠানো হয় দুলদুলি গ্রামের পাম্প হাউসে। সেখান থেকে আবার ওই জল পাম্পের সাহায্যে পাঠানো হয় বিভিন্ন গ্রামে তৈরি ভ্যাটে। ওই সব ভ্যাটের নীচে থাকা কলের মাধ্যমে সেই জল নেওয়ার কথা গ্রামবাসীদের। কিন্তু ২০০৯ সালে আয়লার তাণ্ডবের পরে মাটির নীচ দিয়ে যাওয়া পাইপ জায়গায় জায়গায় ফেটে কিম্বা ফুটো হয়ে যাওয়ার ফলে অধিকাংশ জল ভ্যাটে পৌঁছনোর আগেই মাঝপথে পাইপের ফেটে ফুটে যাওয়া জায়গা দিয়ে পড়ে যায়। ফলে অধিকাংশ ভ্যাটে জল থাকে না। যে সব ভ্যাটে জল পৌঁছয়, দীর্ঘদিন পরিস্কার না করায় ওই ভ্যাটে থাকা কল দিয়ে এতোটাই সরু সুতোর মতো জল পড়ে যে, এক কলসি জল ভরতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। দুলদুলির পাম্প হাউস কর্মী সলিল মণ্ডল বলেন, ‘‘পাইপ ফেটে যাওয়ায় ভ্যাটে যাওয়া জলের বেশির ভাগটাই মাটিতে পড়ে যায়। ফলে ভ্যাট না ভরায় জল সরু ধারায় পড়ে।’’ ৩ নম্বর সাহেবখালি গ্রামের বাসিন্দা রুমা মণ্ডল, সনকা মণ্ডল, সন্ধ্যা মণ্ডল বলেন, ‘‘এক ঘড়া জল নেওয়ার জন্য ভোরে ঘড়া নিয়ে ভ্যাটে পৌঁছে জল নিয়ে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রায় দিনই লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে কলতলায় মারামারি-চুলোচুলি বাধে কারও না কারও সঙ্গে।’’ বিমলা মণ্ডল, সুপ্রিয়া মণ্ডলদের কথায়, ‘‘আমাদের গ্রামে ভ্যাট খারাপ হওয়ায় তিন কিলোমিটার হেঁটে দুলদুলিতে এসে জল নিতে হয়। কয়েক ঘণ্টা জলের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য বাড়ি থেকে কোঁচড়ে বেঁধে মুড়ি-বাতাসা নিয়ে আসতে হয়। এতো করেও অনেক দিন এক ঘড়া জল মেলে না।’’ দুলদুলির বাসিন্দা অরবিন্দ গাইন, অখিল হালদার, অসিত হালদার বলেন, ‘‘আসলে মাটির নীচে দিয়ে যাওয়া পাইপ ফেটে যাওয়া এবং পাম্প মেশিন ঠিক মতো না চালানোর জন্য সময় মত জল আসে না। লম্বা লাইন পড়ে যায়। অনেকে আবার ৩-৪ কিলোমিটার দূরে খইতলা, পুকুরিয়া এবং সাহেবখালি থেকে জল নিতে আসেন। সকলেরই মাথা গরম থাকে।” এই বাসিন্দারা জানালেন, দুলদুলিতে থাকা পাম্প হাউসের পাশে পাইপ ফেটে গিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে। মেরামত করার কেউ নেই। স্বাধীনতার পরে এতো বছর কেটে গেলেও নূন্যতম পানীয় জলটুকু চাহিদা মতো পান না এখানকার মানুষ। আর্সেনিকের সমস্যাও আছে গোদের উপরে বিষ ফোঁড়ার মতো।

মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের সুন্দরবন-লাগোয়া এলাকায় মাটির নীচে পানীয় যোগ্য জলের যথেষ্ট অভাব। অধিকাংশ জায়গায় বারোশো ফুট পাইপ বসিয়েও পানীয় জল মেলেনি। যতটুকু জল পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও পাইপের ফাটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় ভ্যাট ভরছে না। সরু ধারায় জল পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত সুন্দরবন এলাকার মানুষের পানীয় জলের সুরাহা করা যথেষ্ট মুশকিল। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দাবি, এই এলাকার মানুষের মধ্যে পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্য জরুরি নদীর জল শোধন করে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। যা করতে বেশ কয়েক কোটি টাকার প্রয়োজন।

বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেন বলেন, “জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সঙ্গে কথা বলে যাতে দ্রুত পাইপ এবং ভ্যাট মেরামতির কাজ হয়, সে ব্যবস্থা করা হবে।’’

বসিরহাটের নব নির্বাচিত সাংসদ ইদ্রিস আলি। তিনি বলেন, ‘‘যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে উপয়ুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে ভাবেই হোক সুন্দরবন এলাকার মানুষের জন্য পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হবে।’’

এখন দেখার, কবে আসে সেই সুদিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu hingalganj scarcity of water dulduli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE