Advertisement
E-Paper

মডেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম হকারদের দখলে

দৃশ্য ১: বনগাঁ স্টেশনে ট্রেন থামতেই প্ল্যাটফর্মে কোনও মতে ঠেলেঠুলে সবে নেমেছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে আওয়াজ, “দোকানের সামনেটা ছেড়ে দাঁড়াবেন।” আর সহ্য করতে পারলেন না ভদ্রলোক। বললেন, “কোথায় দাঁড়াবো বলে দিন! এটা কী বাজার না স্টেশন?”

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৪ ০২:০০
হাবরা স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বাজার। ছবি: শান্তনু হালদার।

হাবরা স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বাজার। ছবি: শান্তনু হালদার।

দৃশ্য ১: বনগাঁ স্টেশনে ট্রেন থামতেই প্ল্যাটফর্মে কোনও মতে ঠেলেঠুলে সবে নেমেছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে আওয়াজ, “দোকানের সামনেটা ছেড়ে দাঁড়াবেন।” আর সহ্য করতে পারলেন না ভদ্রলোক। বললেন, “কোথায় দাঁড়াবো বলে দিন! এটা কী বাজার না স্টেশন?” ট্রেন থেকে নামা অন্য যাত্রীরা উল্টে সেই যাত্রীকেই বলতে লাগলেন, “সরে ঝগড়া করুন। যেতে দিন।”

দৃশ্য ২: কাঁচরাপাড়া স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটর্ফম। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে সার দিয়ে দোকান। গ্যাসের সিলিন্ডার জ্বালিয়ে বিশাল উনুনে ভাজা হচ্ছে পরোটা। দোকান আর এক চিলতে প্ল্যাটফর্মের মধ্যেই দাঁড়িয়ে কয়েকশো যাত্রী। হঠাত্‌ করেই ঢুকলো ট্রেন। ট্রেনে ওঠা আর নামার হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলিতে কয়েক জন ধাক্কা খেয়ে পড়লেন সোজা পরোটার দোকানের মধ্যে। একটুর জন্য গরম তেলের হাত থেকে রক্ষা পেলেন তাঁরা।

দৃশ্য ৩: হাবরা স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের উপরে এক ব্যক্তির ছোট্ট চালাঘরে এক সময়ে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রির ব্যবসা ছিল। আস্তে আস্তে আরেকটি কচুরি-আলুর দমের দোকান কিনেছেন। এখন কিছু করেন না। দু’টি দোকান ভাড়া দিয়ে এখন মোটরবাইক নিয়ে হাওয়া খেয়ে বেড়ান।

এ সবই নিত্যদিনের চিত্র শিয়ালদহ শাখায়। বস্তুত, হকারের জন্য ট্রেনে ওঠা-নামাই দায় হয়ে পড়েছে শিয়ালদহের মেন, বনগাঁ এবং বসিরহাট শাখায়। অথচ গত পাঁচ বছরে বাংলার চার-চার জন রেল মন্ত্রী ওই শাখাগুলির প্রায় প্রতিটি স্টেশনকেই ‘মডেল স্টেশন’ হিসেবে কাগজে কলমে ঘোষণাও করে দিয়েছেন। ওই শাখার যাত্রীদের অভিযোগ, মডেল স্টেশন হলে যে সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা সে সব মিলছে না। উল্টে, প্ল্যাটফর্ম যে ট্রেনে ওঠা নামার জন্য তৈরি তা-ও ভুলতে বসেছেন রেল কর্তৃপক্ষ।

ওই শাখার স্টেশনগুলিতে গেলেই চোখে পড়বে, দিনে-দিনে জবরদখল এতটাই বেড়েছে যে ক্রমশ সংকীর্ণ হতে থাকা প্ল্যাটফর্মে ওঠানামা করাই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। নিত্য ঘটছে দুর্ঘটনাও। বারো কামরার ট্রেন চালু হয়নি পুরোপুরি। অথচ সম্প্রসারিত প্ল্যাটফর্মগুলিও হকারদের দখলে চলে গিয়েছে। নিত্যযাত্রীরা জানান, সব থেকে খারাপ অবস্থা ওই শাখার বিধাননগর, দমদম, বিরাটি, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, দত্তপুকুর, অশোকনগর, হাবরা, মছলন্দপুর ও বনগাঁ স্টেশনের। অন্য দিকে, বসিরহাট শাখার কদম্বগাছি, হাড়োয়া, ভ্যাবলা এবং মেন শাখার কাঁচড়াপাড়া, নৈহাটি, কাঁকিনাড়া, শ্যামনগর ও ইছাপুর স্টেশনের হালও একই রকম।

কাঁচরাপাড়ায় প্ল্যাটফর্মে দোকান। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, হকার বসানো নিয়ে মদত রয়েছে সব রাজনৈতিক দলের। অথচ এ ব্যপারে হেলদোল নেই রেল কর্তৃপক্ষের। এর দায় রেলের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে রেলপুলিশ। শিয়ালদহের এসআরপি উত্‌পল নস্কর বলেন, “প্ল্যাটফর্মে হকার তোলার ব্যাপারে রেলের তরফে ইদানীংকালে আমাদের কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।” হকারদের জন্য প্ল্যাটফর্মে যাত্রী স্বাচ্ছন্দে যে সমস্যা হচ্ছে তা স্বীকার করে নিয়েছে রেলও। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছার অভাবের কথাই তুলেছে তারা।

রাজ্য রাজনীতিতে যে দল যখন প্রভাবশালী থাকে, হকারদের কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। যেমন হাবরা স্টেশনে অঘোষিত নিয়ম ছিল, যে কোনও প্ল্যাটফর্মের ঠিক মাঝখান থেকে একপাশ সিটু ও অন্যপাশ আইএনটিইউসির দখলে থাকবে। কিন্তু প্লাটফর্ম সম্প্রসারণ হতেই দু’দলের সংঘর্ষে জখম হন ১২ জন। এই টানাপড়েন থেকে শিক্ষা নেয় বারাসত। প্ল্যাটফর্ম দখল নিয়ে সংঘর্ষ এড়াতে তৈরি হয় সর্বদল কমিটি। সেই কমিটিও অবশ্য ভেঙে যায়। বর্তমানে প্রায় সব ক’টি স্টেশনেরই হকাররা রয়েছে তৃণমূল সমর্থিত আইএনটিটিইউসি-র সংগঠন শিয়ালদহ ডিভিশন হকার্স ইউনিয়নের ছাতার তলায়।

সেই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি তাপস দাশগুপ্ত জানান, স্টেশনে তিন ধরনের হকার রয়েছে। স্ট্যান্ডিং (যারা প্ল্যাটফর্মে বসে), মুভিং (যারা প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায়), রানিং (যারা ট্রেনে ওঠে)। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের অসুবিধার কথা স্বীকার করে নিলেও তাপসবাবুর পাল্টা যুক্তি, “ওই তিন ধরনের হকারই গত তিন বছরে তেমন বাড়েনি। তবুও যাত্রীদের যাতে অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারেও আমাদের নজরদারি রয়েছে।”

তবে একটু সতকর্তা নিলে স্টেশনের সৌন্দর্য কী ভাবে ফিরে যায় শিয়ালদহ স্টেশনই তা প্রমাণ। এক সময়ে হকার ভর্তি নোংরা শিয়ালদহকে হকারমুক্ত করে এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। তবে ওই স্টেশনটি পার হলেই বিধাননগর স্টেশন থেকেই চিত্রটা একেবারেই অন্য রকম। কোথাও প্ল্যাটফর্মের একপাশে দোকান আবার তার মাঝখান দিয়েই দু’দিকে মুখ করে সারি দিয়ে বসে গিয়েছে হকার। যাত্রীরা জানান, এক জন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা যা জিনিসের প্রয়োজন সব কিছুরই দোকান রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। এর বেশির ভাগ দোকানই চলছে ভাড়ায়। রাজনৈতিক দলের খাতায় রয়েছে এক জনের নাম, তিনি আবার ভাড়া দিয়েছেন অন্য এক জনকে। যাঁর নামে দোকান, তিনি হয় তো ইহলোকেই নেই। বছরের পর বছর ধরে এ ভাবেই চলছে প্ল্যাটফর্মের দোকান। সংখ্যায় যা বেড়েও চলেছে।

কী বলছে রেল?

পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, “প্ল্যাটফর্মের হকার বাড়লে যাত্রীদের সমস্যা তো হবেই। শিয়ালদহ শাখার ওই স্টেশনগুলিতেও সমস্যা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলি সহযোগিতা করলে হকার সরানো যেতেই পারে। না হলেই সমস্যা। এ ব্যাপারে যাত্রীদেরও সদিচ্ছা, সহযোগিতার দরকার পড়ে।”

model railway station habra arunaksha bhattacharya hawker
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy