Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রোড শো-র শব্দব্রহ্ম বনাম মাথা নুইয়ে গেরিলা প্রচার

গাঢ় সবুজ খোলের লালপেড়ে সাউথ-কটন শাড়ি। মাথা-গলা পেঁচিয়ে জড়ানো বাটিক-কাজ সুতির পাতলা ওড়না। সকাল সাড়ে ন’টাতেই ঝাঁ-ঝাঁ রোদের দাপট, আর তা সামলাতে কখনও কখনও ঘোমটায় পাল্টে যাচ্ছে সেই ওড়না। পান চিবোতে চিবোতে বললেন হুগলি কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রত্না দে নাগ, “সব্বাই আমাকে চেনে। দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি আর এক দিদি। তাই জয় নিয়ে ভাবছি না।” দিদির সেনাপতি বাঁশবেড়িয়ার বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত পাশ থেকে হেসে বললেন, “এ বার তো ব্যবধান বাড়ানোর লড়াই। আগের বার ছিল ৮০ হাজার। এ বার সেটা লাখ খানেকের উপরে উঠবে!”

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫১
Share: Save:

গাঢ় সবুজ খোলের লালপেড়ে সাউথ-কটন শাড়ি। মাথা-গলা পেঁচিয়ে জড়ানো বাটিক-কাজ সুতির পাতলা ওড়না। সকাল সাড়ে ন’টাতেই ঝাঁ-ঝাঁ রোদের দাপট, আর তা সামলাতে কখনও কখনও ঘোমটায় পাল্টে যাচ্ছে সেই ওড়না। পান চিবোতে চিবোতে বললেন হুগলি কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রত্না দে নাগ, “সব্বাই আমাকে চেনে। দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি আর এক দিদি। তাই জয় নিয়ে ভাবছি না।” দিদির সেনাপতি বাঁশবেড়িয়ার বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত পাশ থেকে হেসে বললেন, “এ বার তো ব্যবধান বাড়ানোর লড়াই। আগের বার ছিল ৮০ হাজার। এ বার সেটা লাখ খানেকের উপরে উঠবে!”

তপনবাবুর নেতৃত্বে সপ্তগ্রামের মোড় থেকে রোড-শো বেরোচ্ছে তৃণমূলের। হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। ডজন দু’য়েক মোটরসাইকেলের বুম-বুম-এর সঙ্গে বারো-চোদ্দোটা ‘ছোটা হাতি’র তীক্ষ্ন হর্ন মিশে শব্দব্রহ্ম। ট্রাকের উপরে ঢাউস পতাকা দুলিয়ে মুর্হুমুহু স্লোগান দিচ্ছেন ঘাসফুল-টুপি পরা শ’আটেক কর্মী। মিছিল যখন সেজে উঠছে, স্থানীয় নেতাদের আবদারে এক কর্মীর মোটরবাইকের পিছনে বসে সংলগ্ন এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে এলেন বিদায়ী সাংসদ। মুখে তৃপ্তির হাসি। তপনবাবু নিচুস্বরে বললেন, “দিদি (মমতা)-র উন্নয়ন যজ্ঞে অনেকেই ভুল বুঝতে পারছে। অন্য দল ছেড়ে আসছে তৃণমূলে।”

প্রার্থীকে হুড-খোলা জিপে চড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে জোরশোরে উন্নয়নের দাবি জানানো রোড-শো। গতি রয়েছে, কর্মীদের উদ্যমেও ঘাটতি নেই। তবে যে পথ মাড়িয়ে এই গাড়ি-দৌড়, খানাখন্দে ভরা বহু ঐতিহ্যের সেই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড কিন্তু উন্নয়নের উল্টো বিজ্ঞাপন হয়েই পায়ের নীচে লটকে রয়েছে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে দৌড়নো ছোট ট্রাকে সওয়ার বয়স্ক এক তৃণমূল কর্মী বলেন, “চোখেমুখে হাসি। কখনও রাগতে দেখিনি। দিদির (রত্না) ব্যবহারটি কিন্তু বড় মধুর।”

চুঁচুড়ার গঙ্গার ধারে দেড়শো বছরের পুরনো পৈত্রিক বাড়ি থেকে প্রচারে বেরিয়েছেন অক্সফোর্ডের পিএইচডি বিজেপি প্রার্থী। সঙ্গে হাফ ডজন গাড়ি আর গোটা দশেক মোটরবাইক। হুগলি কেন্দ্রে বিজেপি-র সেনাপতি ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী প্রচার সভায় তাঁদের প্রার্থী চন্দন মিত্রকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘মোদী মন্ত্রিসভার নিশ্চিত সদস্য’ বলে। আদতে দিল্লির বাসিন্দা চন্দনবাবুর মন্তব্য, “গোটা কেন্দ্র ঢুঁড়ে ফেলেছি ক’দিনে। মধুর ব্যবহারের লোক কিন্তু কম নেই হুগলিতে। কথাটা হল সাংসদ হিসেবে তাঁর ভূমিকা কেমন! লোকসভার পরিসংখ্যান বলছে, হুগলি কেন্দ্রের সমস্যা নিয়ে পাঁচ বছরে তিনি সংসদে একটি বারও মুখ খোলেননি। তাঁর করা প্রশ্নের সংখ্যা জিরো।” বিজেপি-র এই কেন্দ্রীয় নেতার অনুভব, শাসক দল দাপিয়ে প্রচার করলেও সাধারণ মানুষ চুপ। আর সেটাই ঘুম কেড়েছে তৃণমূলের। চন্দন মিত্রের আফশোস, জেলায় বিজেপির সংগঠনটা যদি একটু জোরদার হত!

পেশায় সাংবাদিক চন্দনবাবুর প্রশ্ন, জয় নিয়ে তৃণমূল যদি এত নিশ্চিত, তবে বিরোধীদের প্রচারে এত বাধা দেওয়া হচ্ছে কেন? ধনেখালির খাঁপুরে ভরসন্ধ্যায় তাঁর মিছিল পৌঁছলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেদার ঢিল-পাটকেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বিজেপি প্রার্থীর। তাঁর অভিযোগ, হুগলিতে প্রশাসনকে যে ভাবে দলদাসে পরিণত করা হয়েছে, তা-ও বেনজির। চন্দনবাবু কমিশনকে নালিশ করেছেন, হুগলির সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার দাবি জানিয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসন অবশ্য এ অভিযোগ মানেনি।

“হুগলির পুলিশ-প্রশাসন তো গোটাটাই তৃণমূল পার্টিতে পরিণত হয়েছে,” অভিযোগ কংগ্রেস প্রার্থী প্রীতম ঘোষেরও। বললেন, “নালিশ করে করে হাঁফিয়ে গিয়েছি মশাই, কিস্যু করে না। বোঝা যায়, বেচারারা খুবই চাপে রয়েছে।” শেওড়াফুলির পরিচিত ঘোষ পরিবারের ছেলে প্রীতমবাবু। এক সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু আসতেন তাঁদের বাড়িতে, প্রফুল্লচন্দ্র সেনও। হুগলির আদি বাসিন্দা ঘোষেরা। প্রীতমবাবু এআইসিসি-র সদস্য। অনেক পরে নাম ঘোষণা হওয়ায় বেশ পিছিয়েই শুরু করেছিলেন প্রচার। রবিবারের সন্ধ্যায় চন্দননগর-মানকুণ্ডু এলাকায় শ-তিনেক মানুষ আর দশ-বারোটি গাড়ির রোড-শো করে দারুণ উজ্জীবিত তিনি। তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া “তবে? বলা হচ্ছে, কংগ্রেস না কি মরে গিয়েছে?”

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১৯৫১-র প্রথম ভোটেও হুগলি কেন্দ্রে কংগ্রেস জেতেনি। জয়ী হন হিন্দু মহাসভার এন সি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পর পর ছ’টি নির্বাচনে হুগলি ছিল কমিউনিস্ট-দখলে। ইন্দিরা হত্যার সহানুভুতির হাওয়ায় ১৯৮৪-তে প্রথম কংগ্রেসের ইন্দুমতী ভট্টাচার্য জেতেন হুগলিতে। তার পরে আবার ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত টানা ছ’বার জয়ী হন সিপিএমের রূপচাঁদ পাল। ১৫টা লোকসভা নির্বাচনের ১২টিতেই জেতা বামেদের সংগঠনকে এ বার সে ভাবে কেন দেখা যাচ্ছে না হুগলিতে?

প্রশ্নটা করা গিয়েছিল বলাগড়ের সিপিএম নেতা পরিতোষ ঘোষকে। ১৯৬৫-র পার্টি সদস্য, দীর্ঘদিন নির্বাচন পরিচালনা করছেন হুগলির গ্রামীণ এলাকায়। হেসে বললেন, “আসলে আমরা এ বার প্রচারের ধারাটাই পাল্টে ফেলেছি। আমরা দেখা দিতে চাইছি না, তাই দেখাও যাচ্ছে না।” কেমন সে প্রচার? পরিতোষবাবু বোঝালেন, “আমরা রোড-শো-র বদলে ছোট ছোট গ্রামসভা করছি। মানুষকে নিয়ে বসে বলছি আমাদের কথা। বলছি, বিচার করে ভোটটা দিন।” সিপিএম কি গোপন সংগঠন নাকি, যে এ ভাবে গেরিলা কায়দায় আবডালে থেকে প্রচার করতে হবে? ফের হাসলেন পোড় খাওয়া বাম নেতা। বললেন, “তা নয়। মানুষ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তা মাথা পেতে নিয়েছি। তার পরে লোক দেখানো আস্ফালন তো আমাদের সাজে না।” সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা বললেন, “কত যে গ্রামসভা করছি। মুখোমুখি বসে মানুষের কত প্রশ্নের যে জবাব দিচ্ছি। এমন সাড়া পাব ধারণার বাইরে ছিল।” কী বলছেন ভোটারদের? প্রদীপবাবু বলেন, “আমরা ব্যক্তিগত কুৎসা করি না। যা ঘটছে চারদিকে, তা দেখে মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে বলছি। চিটফান্ডে প্রতারিত মানুষ, টেট পরীক্ষায় প্রবঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের বোঝাচ্ছি, এই তো হচ্ছে অবস্থা।”

আর ধনেখালি তো আছেই। এখানে দলেরই কর্মীকে খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে তৃণমূল বিধায়ক অসীমা পাত্রের। রাজ্য সরকার বিরোধিতা করলেও সিবিআইয়ের হাতে তদন্ত-ভার গিয়েছে আদালতের নির্দেশে। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের শাসানি ও গাজোয়ারিতে, ফাজলামিতে পরিণত হয়েছিল ধনেখালির পঞ্চায়েত ভোট। মোটরবাইক দাপিয়ে এখনও সেখানে পাক খাচ্ছে কড়া চোখের ছেলেরা। সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা বললেন, “ধনেখালিই ফ্যাক্টর। তবে এ বার মানুষ ভোট দেবেন। মার খেয়েও মাঠ ছাড়বে না আমাদের কর্মীরা।” একই যুক্তিতে চোখরাঙানি সত্ত্বেও ভাল সাড়া পাওয়ার আশা করছেন বিজেপি, কংগ্রেস প্রার্থীরা।

কমে আসে রোদ, সাহাগঞ্জে বন্ধ ডানলপ কারখানার মরচে পড়া গেটের সামনে রংচঙে মঞ্চে আলোর রোশনাই। ‘ভোট দিন, ভোট দিন’ স্লোগানের দাবড়ানি। আজ তৃণমূল, তো কাল সিপিএম বা বিজেপি। রোগা রোগা শ্রমিকেরা উদাসীন চোখে ঘাম মোছেন রংচটা গামছায়। এপ্রিলের শেষ দিনে হয়তো তাঁরাও দাঁড়াবেন ভোটের লাইনে। ঘরমুখো গরুর খুরের ধুলোয় সন্ধ্যা নামে সিঙ্গুরে। এক্সপ্রেসওয়ের ধারে পড়ে থাকে টাটাদের কারখানার মমি। সানাপাড়া, বেড়াবেড়ি, খাসের ভেড়ি জুড়ে আশাভঙ্গের বেদনার মধ্যেও ভোট। ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক কৃষক আগেপিছে দাঁড়াবেন ভোটের লাইনে।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবির সৃষ্টির আদলে ফেস্টুন কংগ্রেসের ‘পড়ে থাকে অন্ধকার/ মুখোমুখি বসিবার/ সারদার সুদীপ্ত সেন।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anamitra chattopadhyay hooghly loksabha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE