তখন সুদিন (ফাইল চিত্র)।
ফুটবল ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। দুটো পায়ে তো বটেই, মাথা, হাত, কাঁধ— শরীরের সব জায়গাতেই বলকে ‘কথা বলাতে’ পারতেন তিনি। শুধু ৯০ মিনিট নয়, ২৪ ঘণ্টা বল মাথায় নিয়ে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা ছিল তাঁর কাছে জলভাত। স্বপ্ন দেখতেন, নিজের ‘মেরা ভারত মহান’ লেখা তেরঙ্গা রঙের বলটাকে টানা ১০০ ঘণ্টা মাথায় রেখে ভারতীয় হিসেবে নাম তুলবেন গিনিস বুকে।
স্বপ্ন তিনি এখনও দেখেন। কিন্তু হাত, পাগুলো আর কথা শোনে না। স্নায়ুর দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী সেই মানুষটি এখন নিজের ছেলেকে তৈরি করছেন নিজের স্বপ্ন সফল করবার জন্য।
লোকটির নাম মীর কামালউদ্দিন। হাওড়ার সাঁকরাইলের মানিকপুর গ্রামের ডেল্টা জুটমিলের পাশ দিয়ে ৫ মিনিট হাঁটলে একচিলতে ঝুপড়িতে ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিনযাপন। ছোট থেকেই ফুটবল ছিল তাঁর নেশা। রেলওয়ে এফ সি, খিদিরপুর, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে দাপিয়ে খেলেছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে মহমেডান এসির হয়ে খেলার সময়েই চোট পান। ফুটবলার জীবন শেষ হয়ে যায় ওখানেই। কিন্তু পা ফুটবল খেলা ছাড়লেও মন থেকে ফুটবলকে ছাড়তে পারেননি কামাল। মাঠে গিয়ে এলাকার খুদেদের প্র্যাকটিস করাতেন। সেই সময়েই শুরু করেন বল নিয়ে জাগলিং।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে মুর্শিদাবাদে বল জাগলিংয়ের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন কামাল। তারপরেও ২০১৩ সালের ১২ ফ্রেব্রুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বল জাগলিং করেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই বছরের মার্চ মাস থেকেই ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করে সারা শরীর। প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় চিকিৎসক ‘ফিজিওথেরাপি’ করলেও লাভ হয়নি। চিকিৎসার জন্য তাঁর পরিবার কালামকে দিল্লি নিয়ে যান। কিন্তু টাকার অভাবে প্রথমে চিকিৎসাই শুরু করা যায়নি। শেষে বর্তমানে দিল্লিবাসী সাঁকরাইলের এক মহিলার সাহায্যে চিকিৎসা শুরু হয়। মাস কয়েক চিকিৎসা করানোর পরে বাড়ি ফিরে এলেও এখনও সুস্থ নন কামাল। তবে তার মধ্যেই নিজে বিছানায় শুয়ে জাগলিং শেখান ছেলে কাইজারউদ্দিন মীরকে। নবম শ্রেণির ছাত্র কাইজারের ডাক আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকেও।
বলের জাদু দেখাতে কালাম ডাক পেয়েছিলেন বেসরকারি হিন্দি ও বাংলা টেলিভিশনে। সে রকমই এক অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা ছিলেন রাখী সাওয়ান্ত। মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর বল জাগলিংয়ে। ২০১২ সালের দুর্গাপুজোয় কলকাতার ভিআইপি রোডের পাশে কেষ্টপুরের শিবকালী স্পোটিং ক্লাবের মঞ্চে টানা ২০ ঘণ্টা মাথায় ফুটবল রেকর্ড করেছিলেন তিনি। ওই মঞ্চেই তাঁকে সংবর্ধনা দেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক (তখনও সাংসদ হননি) প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এখন কামালুদ্দিন। ছবি তুলেছেন রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।
কালামের স্ত্রী অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী, দাদারা ছিলেন এলাকার একটি জুটমিলের কর্মী। সেই জুটমিল এখন বন্ধ। ঝুপড়ি ঘরে চলে কোনওক্রমে দিনযাপন। কামালউদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভ, “বিভিন্ন মঞ্চে অনেকেই ভাইকে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ভাই অসুস্থ হওয়ার পরে কেউ খোঁজও নেননি।”
কালামকে কলকাতা ও জেলা ময়দানের কিছু প্রাক্তন ও বর্তমান ফুটবলার আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। মহমেডান স্পোর্টিংয়ের ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, “কলকাতা ময়দানের ফুটবলাররা এর আগে কালামকে কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিল। তবে এককালীন সাহায্যের থেকেও ওঁর মাসিক সাহায্যের প্রয়োজন। সরকার এগিয়ে এলে ভাল হয়।” পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম প্লেয়ার্স কর্নার থেকেও কালামকে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছিল।
ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের কর্তা, পেশায় চিকিৎসক শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্তের আক্ষেপ, “খেলোয়াড়েরা বিনোদন দেয়। কিন্তু তাঁদের বিপদে পাশে থাকার লোক দিন দিন কমছে। সরকারের উদ্যোগী হয়ে গরিব খেলোয়াড়দের জীবনবিমার ব্যবস্থা করা উচিত।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “অনেক সময়ে পেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলে শরীরের ভারসাম্য ক্ষতি হতে পারে। কামালউদ্দিনের ক্ষেত্রে সেটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ওঁর পরিবার যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে আমি তাঁকে অবশ্যই সাহায্য করব।”
প্রাক্তন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কালামের লোকসভা কেন্দ্রের (হাওড়া সদর) সাংসদ। প্রসূনবাবু বলেন, “কালাম খুব ভাল ছেলে। দিল্লিতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার সময়ে আমি ওঁকে কিছু সাহায্য করেছিলাম। যে কোনও কারণেই হোক, ওকে দিল্লিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ওঁর পরিবার যেন আমার উপর অভিমান না করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy