Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কঙ্কালের পাশে কি কেউ ফেলে গিয়েছিল ঝকঝকে স্কুলব্যাগ

ভুলে যাওয়া সময়ের ডায়েরিতে হলদে পাতা ওড়ে, তাতে শুকনো রক্তের দাগ। এক সময়ে হইচই ফেলে দেওয়া খুন-জখমের ইতিবৃত্ত চুপ করে থাকে পুলিশ ফাইলে। নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এক দিন সংবাদের কেন্দ্রে চলে আসা আত্মীয়-পরিজন। কিনারা হয়েছে কি সব রহস্যের? ভুলে কি গিয়েছে সবাই? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।জোৎস্না ধোওয়া রাত বড় প্রিয় ছিল তার। পূর্ণিমায় ছোপানো ছোট্ট উঠোন আর ছাদ বড্ড টানত তাকে। জোৎস্না আজও আসে, ভিজিয়ে দিয়ে যায় বাড়ির দাওয়া-ছাদ। সেই নরম আলোয় এক মা তার ছেলেকে খোঁজেন। জানেন যে, সে কোনও দিন ফিরবে না।

সুপ্রকাশ মণ্ডল শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৬ ০২:২৮
Share: Save:

জোৎস্না ধোওয়া রাত বড় প্রিয় ছিল তার। পূর্ণিমায় ছোপানো ছোট্ট উঠোন আর ছাদ বড্ড টানত তাকে। জোৎস্না আজও আসে, ভিজিয়ে দিয়ে যায় বাড়ির দাওয়া-ছাদ। সেই নরম আলোয় এক মা তার ছেলেকে খোঁজেন। জানেন যে, সে কোনও দিন ফিরবে না। তবুও জোৎস্না দেখলেই বারবার মনে হয়, তাঁর অমিত যেন রোয়াকে বসে রয়েছে।

বারোটা বছর হয়ে গেল। তবু মনে হয়, এই তো সে দিন...

চারদিকে তখন আগমনীর সুর। ক’দিন পরেই পুজো। কেন কে জানে, অন্য বারের তুলনায় সে বার ছেলেকে বেশি খুশি মনে হয়েছিল গয়েশপুর গোকুলপুরের দীপিকা সাহার। কিন্তু বোধনের আগেই বিসর্জনের বাজনা বেজে গেল। হঠাৎ কো‌থায় হারিয়ে গেল হরিপদ আর দীপিকার একমাত্র সন্তান, ক্লাস টুয়েলভের অমিত।

দিনটা ছিল ২০০৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। দুপুরে টিউশন পড়তে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি অমিত। পরের দিন কল্যাণী থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন হরিপদ। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ... খোঁজ আর মেলে না। দিনের পর দিন চলে যায়। কেঁদে-কেঁদে শুকিয়ে কালো হয়ে যায় মায়ের চোখের কোল।

তিন মাস পরে হঠাৎ খবর এল, গয়েশপুর কাঁটাগঞ্জ স্পিনিং মিলের পিছনের জঙ্গলে একটা স্কুলব্যাগ পাওয়া গিয়েছে। পাশে একটি কঙ্কাল। খবর পেয়ে হরিপদ ছুটলেন। কঙ্কাল দেখে কি মানুষ চেনা যায়? কিন্তু ওই স্কুল ব্যাগ তো চেনা! জামা-প্যান্ট... হ্যাঁ, সে-ও তো অমিতেরই! তা হলে তো... কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কঙ্কালকেই নিজের ছেলে বলে শনাক্ত করলেন হরিপদ।

২০০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি।

নিখোঁজ ডায়েরি পাল্টে গেল খুনের মামলায়। পুলিশ তদন্তে নামল। তদন্ত খানিক এগোতেই জানা গেল, কাঁটাগঞ্জের এক স্কুলছাত্রীর প্রেমে পড়েছিল অমিত। কিশোরীটির দেওয়া চিঠি আর গ্রিটিংস কার্ডও মেলে অমিতের ঘর থেকে। কিন্তু কিশোরীর বাড়ির লোক জেনে গিয়েছিলেন আর বিষয়টা তাঁদের পছন্দও ছিল না। পরে অন্য আর একটি ছেলেও সম্ভবত জড়িয়ে গিয়েছিল সম্পর্কের ত্রিকোণে।

অমিতের বাবা-মা অবশ্য কিচ্ছুটি জানতেন না। পরে হরিপদ পুলিশকে জানান, সম্পর্ক ছিন্ন না করলে তাকে খুন করা হবে বলে শেখর দাস নামে কিশোরীর এক নিকটাত্মীয় অমিতকে হুমকি দিয়েছিলেন। কঙ্কাল উদ্ধারের পরের দিন রাতে পুলিশ শেখরকে গ্রেফতার করে। কিশোরী ও অমিতের দুই বন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয়।

দেড় মাসের মাথায় অবশ্য জামিন পেয়ে যায় সকলেই। পাঁচ মাসের মাথায় মামলার শুনানি শুরু হয়। এক বছর পর বেকসুর খালাস হয়ে যান শেখর। বাকি সকলে তখন নাবালক। তাদের বিচার হয়েছিল কৃষ্ণনগর জুভেনাইল আদালতে। ন’বছর মামলা চলার পরে খালাস হয়ে যান তাঁরাও।

সকলেই যদি নিরাপরাধ হন, তবে খুনটা করল কে? ময়নাতদন্ত এবং ফরেনসিক রিপোর্ট তো জানিয়েছিল, খুনই করা হয়েছে অমিতকে। কিন্তু কেন আদালতে কারও অপরাধ প্রমাণ হল না?

এই ব্যর্থতার জন্য বিচারক কাঠগড়ায় তুলেছেন পুলিশকেই। এত অসঙ্গতি রয়ে গিয়েছিল গোড়া থেকে যে পরে মামলা কেঁচে যায়। তিন মাসে অমিতের দেহ কঙ্কালে পরিণত হলেও স্কুলব্যাগ বা বইপত্র ছিল প্রায় নতুন। কেন, তার কোনও উত্তর তদন্তে উঠে আসেনি। হরিপদর যে আত্মীয় অভিযোগপত্র লিখেছিলেন, আদালতে তিনি জানান, থানার ওসি অভিযোগপত্র লিখে দিয়েছেন।

বেকসুর খালাস হয়ে গিয়ে শেখর তো এখন অমিত আদৌ খুন হয়েছে বলেই মানতে চান না। তাঁর যুক্তি, ‘‘ওই কঙ্কালের কোনও ডিএনএ টেস্ট হয়নি। ক্লাস টুয়েলভের বই-খাতা তো এমনিই ফেলে রেখে যাওয়া যায়!’’ শেখর ভাল করেই জানেন, আদালত অব্যাহতি দিলেও একটা অভিশাপের ছায়া যেন কোথায় ঝুলে আছে।

‘‘ওই একটা ঘটনা আমার জীবনটা শেষ করে দিল! অমিতকে আমি কোনও দিন দেখিইনি। যখন ছেলেটা নিখোঁজ হয়, তখন আমি কাঠমান্ডুতে। কখন কোথায় ছিলাম, তার সব প্রমাণ পুলিশকে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ বলেছিল, তাদের কাউকে গ্রেফতার করতেই হবে’’— দাবি শেখরের।

একটু দম নিয়ে শেখর ফের বলতে শুরু করেন— ‘‘সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছি। ইকনমিক্স অনার্সের পরে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সরকারি চাকরির চেষ্টাও চলছিল। সব শেষ হয়ে গেল। বাবার চাকরিটাও পেলাম না! রাস্তায় লোকে আমায় দেখিয়ে বলত, ওই যে ‘কঙ্কাল শেখর’ যাচ্ছে! আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। নিকটাত্মীয়দেরও নয়।’’

হরিপদ আদালতে জানিয়েছিলেন, শেখরকে তিনি সরাসরি চিনতেন না। অমিতের সঙ্গে কিশোরীর সম্পর্কের কথাও তিনি এলাকায় শুনেছিলেন মাত্র। সেই এক দিনই, সাক্ষ্য দিতে আদালতে গিয়েছিলেন হরিপদ। নিজে আলাদা করে কোনও আইনজীবী দাঁড় করাননি। সরকারি আইনজীবীই যা করার করেছেন। যদিও মোটামুটি যে ব্যবসা করেন হরিপদ, তাঁর একেবারে সঙ্গতি ছিল না, তা নয়। অথচ, কবে মামলা শেষ হয়েছে, তার খবরটুকুও তিনি রাখেননি। কেন এত নির্বিকার?

‘কী হবে ও সব করে? যে যাওয়ার, সে তো চলেই গিয়েছে!’’ নিভে আসা গলায় বলেন হরিপদ। যখন তিনি এ কথা বলছেন, তার সামান্য আগেই অবশ্য টের পাওয়া গিয়েছে তাঁর ঝাঁঝ। গোকুলপুরে তাঁদের একতলা বাড়িটা গত দশ-বারো বছরে প্রায় একই রকম রয়ে গিয়েছে। বাইরে রঙের পোঁচ পড়েছে কেবল। ভিতর থেকে সাড়াশব্দ প্রায় মেলেই না। বহু বার ডাকার পরে বেরিয়ে আসেন হরিপদ। এবং অমিতের কথা তুলতেই ভয়ঙ্কর রেগে যান। বারবার একটাই কথা বলতে থাকেন— ‘‘এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। কী হবে? আমার ছেলেটা কী ফিরবে?’’

দীপিকা যেন এই সব কিছুর বাইরে। এক দমকায় দপ করে তাঁর দীপ নিভে গিয়েছে।

জোৎস্নায় বাড়ির আনাচে-কানাচে তিনি শুধু ছেলেকে খুঁজে বেড়ান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

skeleton schoolbag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE