Advertisement
E-Paper

ডুয়ার্সের দুয়ারে পায়ে পায়ে

কাঞ্চনকন্যা শিলিগুড়ি জংশন ছাড়াতেই বুঝলাম, ডুয়ার্সের দুয়ারে হাজির ট্রেন। তার ঝিকঝিকানি আর ঘন ঘন হুইসল যেন সমগ্র ডুয়ার্সকে বলছে, ‘দেখো, আমি এসে গিয়েছি’।

জাহির রায়হান, ১২ নম্বর ওয়ার্ড, বেলডাঙা

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩০

কাঞ্চনকন্যা শিলিগুড়ি জংশন ছাড়াতেই বুঝলাম, ডুয়ার্সের দুয়ারে হাজির ট্রেন। তার ঝিকঝিকানি আর ঘন ঘন হুইসল যেন সমগ্র ডুয়ার্সকে বলছে, ‘দেখো, আমি এসে গিয়েছি’।

আমারও একই অবস্থা। শিয়ালদহ থেকে শিলিগুড়ি অবধি এক বারও মনে হয়নি, কিন্তু চার দিকে সবুজের সমারোহ দেখে মনে হচ্ছে, আমি এখন ঘরের বাইরে। রোজকারের একঘেয়েমি থেকে অনেক দূরে। মনে হতেই, পকেটের মোবাইলটা একবার দেখে নিলাম। নাহ, সিগনালটা এখনও যায়নি। তবে যাব যাব করছে।

গন্তব্য কুমলাই। মালবাজারে নেমে সেখান থেকে সোজা...। কিন্তু তার আগেই রেলপথের দু’ধারের ঘন সবুজ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মাঝে ডামডিম নদী পার হলাম। হঠাৎ হঠাৎ নির্জন দু’একটি স্টেশন পেরিয়ে যায়। প্রকৃতির নিস্তব্ধতার বুক চিড়ে গর্জন করতে করতে ছুটে চলে কাঞ্চনকন্যা। আর ভিতরের জং লেগে থাকা মনটা থেকে পলেস্তারাগুলো একটু একটু করে খসে পড়তে থাকে। একাই বেরিয়েছি। একা একাই ঘুরব নিজেকে নিয়ে। অনেক দিন নিজের সঙ্গে কোনও কথা বলা হয়নি।

কী করে যাবেন?

হাওড়া, শিয়ালদহ কিংবা কলকাতা স্টেশন থেকে
আলিপুরদুয়ারগামী ট্রেনে মালবাজার।
সেখান থেকে জিপ বা ট্রেকারে চেপে সোজা কুমলাই।

কখন যাবেন?

জুন-সেপ্টেম্বর, বছরের এই তিনটে বর্ষা-মাস
ছাড়া বছরের যে কোনও সময় যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন?

থাকা-খাওয়ার জন্য বেনফিশ-এর ‘আরণ্যক ট্যুরিস্ট লজ’।

মালবাজার স্টেশন থেকে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজের চাদর, আরও দূরে নাম-না-জানা গাছের ফাঁকে পাহাড়ের লুকোচুরি। কোথায় যেন শুনেছিলাম, সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ ভাল থাকে। হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম। জিপে চেপে কিছুটা পথ। তার পর একটা ভ্যান রিকশায় ‘কুমলাই ফিশিং প্রজেক্ট’।

গাছগাছালি ঘেরা একটা পুরনো বাংলো। আপাত নির্জন গ্রাম্য পরিবেশ— দিন দুই হারিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ। দুই শয্যার কামরা, গড়ের মাঠের মতো বড় বিছানা। সে বিছানা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে হবে না ভেবেই মনটা ভাল হয়ে গেল। জানালা খুলেই দেখি, বাইরে নিভু নিভু অন্ধকার।

স্নান, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকিয়ে উঠছি, ম্যানেজার ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনার প্রোগ্রাম কী?’’ আমি পাল্টা জালতে চাইলাম, ‘‘কী করা যায় বলুন তো?’’ উনি হেসে ফেললেন। বললেন, ‘‘গরুমারা অভয়ারণ্যে যেতে পারেন। ৬ কিলোমিটার দূরে।’’

কিন্তু কীসে যাব?

—ভ্যান রিকশা। ফের নিজেই বললেন, ‘‘কিন্তু ফিরবেন কীভাবে? সন্ধেয় তো ভ্যান পাবেন না। তা হলে?’’ মুশকিল আসান করলেন অবশ্য উনিই। জানালেন, পাঁচ জনের একটি দল রয়েছে ওখানে। ওদের গাড়িতেই চলে আসা যাবে। উনি ফোন করে জানিয়ে দেবেন।

কিন্তু যাওয়ার সময় ভ্যানও পাওয়া গেল না। অগত্যা এক জনের সাইকেলে চেপে বসলাম আমি। সে-ও এক নতুন অভিজ্ঞতা। চা-বাগানের পথ ধরে, অজানা সব গাছগাছালি দেখতে দেখতে জঙ্গলের উদ্দেশে। গরুমারা নামের মানে কী? কে জানে!

ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাতি, কিছু পাখি দেখে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে জঙ্গলে একটা কাঠের তৈরি কটেজ দেখে সেখানে এক রাত্রি যাপনের ইচ্ছা বুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। স্থানীয় অধিবাসীদের নৃত্যশৈলী দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। সেটা দেখলাম। ইতিমধ্যে ওই দলটির সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাঁদের গাড়িতেই গাছের সবুজের সঙ্গে রাতের অন্ধকারের মাখামাখি দেখে নিজ ঠিকানায় ফেরা। নৈশভোজ শেষে ঝিঁঝিঁপোকার ঐকতান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলাম, টের পাইনি।

ঘুম ভাঙল পাখিদের হুল্লোরে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কোনও মতে জামাকাপড়টা জড়িয়ে ছুটলাম কুমলাই নদী দেখতে। শুনেছি, ভোরবেলা দেখতে খুব সুন্দর লাগে।

হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে নদীটা। সে জল এত স্বচ্ছ, যেন একটা প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়াম। কুচি কুচি মাছগুলো জলের তলায় হুটোপাটি করছে।

ফিরে এসে হোটেলে সে কথা বলতেই ম্যানেজার বললেন, কুমলাই নদীটা কিছুটা গিয়ে ডামডিম নদীতে পড়েছে।

দুপুরে খেতে বসে একপ্রস্ত অবাক হওয়ার পালা। কুচোমাছের তরকারি! হোটেলের কর্মী মাসিমার দিকে তাকাতেই হাসি হাসি মুখে বললেন—‘‘কুমলাই নদীর মাছ। খেয়ে দেখুন, ভাল লাগবে।’’ সত্যিই অপূর্ব তার স্বাদ। নিমেষে ফুরিয়ে গেল খাবারের থালাটা। অনেক ধন্যবাদ জানালাম ম্যানেজার ও মাসিমাকে।

এ বার ফেরার পালা। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাজার অবধি ভ্যান-রিকশার যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম।

এখনও মনে হয় যেন হাঁটছি, হেঁটেই চলেছি...।

Dooars
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy