রঙিন: গত বছর রবীন্দ্র পার্কে বসন্ত উৎসব। নিজস্ব চিত্র
মিলবে কি ঠাঁই! উদ্বিগ্ন কলকাতাবাসী এক তরুণ। ঝাড়গ্রামের এক বাসিন্দাকে ফোনে ধরেছিলেন। একটা হোটেল-গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা যদি করে দেন। দোলের দিনে সপরিবারে অরণ্যশহরে কাটাতে চান তিনি। কিন্তু পরিচিতের উত্তর আরও পরিচিত। একেবারে রাবীন্দ্রিক, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’।
গত কয়েক বছর ধরে দোল-বসন্ত উৎসবের সময়ে ঝাড়গ্রামের পরিচিত দৃশ্য এইরকমই। এ বছরেও গত বছরের দোল যাপনের পুনরাভিনয় হবে। তার যাবতীয় প্রস্তুতি সারা। দোলের দিন ঝাড়গ্রামের কোনও লজ, হোটেল খালি থাকবে না। হোটেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললেই সে বিষয়ে নিশ্চয়তা মিলছে। ঝাড়গ্রাম হোটেল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকারের সাফ কথা, “২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ সব হোটেলে অগ্রিম বুকিং হয়ে গিয়েছে। দোলকে কেন্দ্র করে এবার অনেকেই উইক এন্ড ট্যুরে আসছেন।’’
বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতনের পরে ঝাড়গ্রাম কেন ধীরে ধীরে পর্যটকদের দ্বিতীয় গন্তব্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে? ঘটনা পরম্পরার ফল বলছে, এই সময়ে ঝাড়গ্রামে কাটালে একের মধ্যে তিনের স্বাদ মেলে। প্রথমে তো রঙের উৎসব। শহরের রবীন্দ্র পার্ক এবং ঘোড়াধরা পার্ক রঙিন হয়ে যায়। তারপর স্থানীয় লোকসংস্কৃতি এবং লোকশিল্পের সঙ্গে পরিচয়। দূরে যেতে হয় না। শহরেই নিজেদের শিল্পের পসরা নিয়ে হাজির হন শিল্পীরা। আর বাড়তি পাওনা শাল, পিয়াশাল, শিমূলে ঘেরা জঙ্গল শহরের অনন্য রূপ দর্শন।
কেমন সেই লোকসংস্কৃতির রং? গত কয়েক বছরে শহরের রংবাহারের কয়েকটি ঝলক দেখলেই বোঝা যাবে। স্থান, রবীন্দ্র মুক্ত মঞ্চ। ঝুমুর শিল্পী ইন্দ্রাণী মাহাতো মঞ্চে। গাইছেন, ‘মনচরা লাঠুয়া বনমালী, তর সংগে রিঝে রঙে খেলইব নাই আর হুলি’। রঙের গান। নাটুয়া বনমালী অর্থাৎ কৃষ্ণের সঙ্গে হোলি খেলতে অনীহা প্রকাশ রাধিকার। আসলে এই নারাজ রাধার মধ্যে অভিমানী সলাজ রাধার হোলি খেলার ইচ্ছে। মঞ্চে জঙ্গলমহলের ঝুমুর গায়িকার গানের সুর। আর মঞ্চের নীচে ধামসা-মাদলের তালে মাতোয়ারা একদল পর্যটক। লাল-সবুজ-গোলাপি আবিরে একে অপরকে রাঙাচ্ছেন। খানিক পরেই ইন্দ্রাণী গান ধরলেন, ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন পালাব পালাব মন, নেংটি ইঁদুরে ঢোল কাটে রে, কাটে রে বতরে পিরিতির ফুল ফুটে’।
মঞ্চের সামনে তখন পলাশের গাঁথা মালা পরিয়ে বরণ করা হচ্ছে অতিথিদের। গানের পরে রণপা আর রায়বেঁশে নাচের দল। নাচিয়েদের কসরতে মন্ত্রমুগ্ধ পর্যটকেরা।
কলকাতার হঠাৎ ঝাড়গ্রামমুখী হয়ে ওঠার অন্য কারণ রয়েছে। জঙ্গলমহলের অশান্ত পর্বে পর্যটন ব্যবসা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আশঙ্কায় জঙ্গলমহল থেকে মুখ ফিরিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মাওবাদী সন্ত্রাসপর্ব শেষ হতে নতুন করে সাজছে ঝাড়গ্রাম। পর্যটক টানতে ঝাড়গ্রামের একটি সংস্থা রবীন্দ্র পার্কে এখন প্রতি বছর অরণ্যশহরে বসন্ত উত্সবের আয়োজন করে। সংস্থার কর্তা সুমিত দত্ত জানালেন, জঙ্গলমহল সম্পর্কে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ২০১৪ সাল থেকে বসন্ত উত্সব শুরু করা হয়। ক্রমে আবির রাঙা উত্সবটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। এবার উত্সবের পঞ্চম বর্ষ। গত বছর থেকে শহরের ঘোড়াধরা পার্কে কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে আরেকটি বসন্ত উত্সব শুরু হয়েছে। এ বছর তাদেরও প্রস্তুতি সারা।
ঘোড়াধরা পার্কে গত বছর এক টুকরো শান্তিনিকেতন উঠে এসেছিল। সংস্থার সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ব্রত বেরা সে কথাই জানালেন। জানালেন, তাঁদের উৎসব পুরোপুরি রবীন্দ্রময়। দোলের দিন প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান, ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল’। এরপর ঘোড়াধরা পার্কে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে চলবে দোলখেলা। পার্কে দোলের আনন্দের সঙ্গে বনভোজনের মজা। রং খেলার পরে দুপুরে পাত পেড়ে খাওয়ারও আয়োজন করেছেন প্রিয়ব্রতবাবুরা। তাঁরাও বেশ কিছু পর্যটককে নিয়ে আসছেন শহরে। প্রিয়ব্রতবাবুদের বসন্ত উত্সবে আসার কথা কয়েকজন বিশিষ্টজনেরও।
শহরের অনেকে দোলে রাবীন্দ্রিক ছোঁয়ায় খুশি। শান্তিনিকেতনে যাওয়া হয় না। এক টুকরো শান্তিনিকেতন নিজেই নাগালের মধ্যে হাজির। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, “শান্তিনিকেতনের আদলে এমন দোল উদ্যাপনের আয়োজনে অরণ্যশহরের কৌলীন্য বেড়ে গিয়েছে।” উদ্যোক্তারা আবার দাবি করছেন, কলকাতার একাংশ শান্তিনিকেতনে না গিয়ে ঝাড়গ্রামে দোল খেলতে আসছেন। কলকাতার বাসিন্দা হর্ষ ভৌমিক। তাঁর কথায়, ‘‘ঝাড়গ্রামে একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে রং খেলা যায়। নানা ধরনের সাংস্কতিক অনুষ্ঠান বিশেষত, জঙ্গলমহলের স্থানীয় লোকসংস্কতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে।’’
হর্ষবাবুর কথার সত্যতা মেলে রবীন্দ্র পার্কে। সেখানে থাকে মেদিনীপুর তথা জঙ্গলমহলের হস্তশিল্প সামগ্রীর পসরাও থাকছে। ঝাড়গ্রামেরই বেলপাহাড়ির কালো পাথরের তৈরি থালা-বাটি, মূর্তি মেলে এখানে। বিক্রি হয় জেলার বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের মোষের শিংয়ের কারুকাজ তো নয়নাভিরাম। ঘর সাজানোর উপকরণ সেগুলো। প্রিয়জনদের উপহারও দেওয়া যায় সে সব শিল্পকর্ম। দোল দেখার পরে শপিংয়ের সুযোগ থাকছেই। যে সুযোগ থাকে শান্তিনিকেতনেও। স্থানীয় শিল্পকর্মের আলাদা চাহিদা রয়েছে সেখানে। এই ত্রিমুখী সুবিধার জন্যই ঝাড়গ্রামে হাজির হন হিমন সান্যাল, রামরাজীব ভট্টাচার্য, মীনাক্ষী চৌধুরীরা। কেউ আসছেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে। কেউ পরিবার নিয়ে।
রবীন্দ্র পার্কের বসন্ত উত্সবটি বরাবরই পর্যটকদের জন্য আমন্ত্রণমূলক। এবারও তাই। অন্যদিকে, ঘোড়াধরা পার্কের নতুন বসন্ত উত্সবে সকলেই স্বাগত বলে জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির ঝাড়গ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শঙ্করপ্রসাদ পাল ও পিনাকীপ্রসাদ রায় জানাচ্ছেন, “ঘোড়াধরা পার্কের আমাদের বসন্ত উত্সবে সকলেই স্বাগত। কোনও প্রবেশ মূল্যও নেই। তবে দুপুরের খাবারের জন্য সবার কাছে সাধ্যমতো সামান্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে।’’ সেই চাঁদা তুলে চড়ুইভাতির আয়োজনের মতো অনুভূতি। শীতকালের বদলে বসন্তে তার আয়োজন। এটাই যা তফাৎ।
চাহিদা বাড়ার জন্যই দুই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা নতুন কিছু করার কথা ভাবছেন। আরও নতুন কিছু করার। কারণ যত বেশি পর্যটক আসবেন, তত বেশি পর্যটনের প্রসার ঘটবে। বেশি সংখ্যায় পর্যটকরা এলে উপকৃত হবেন জঙ্গলমহলের প্রান্তিক আদিবাসী-মূলবাসী মানুষজন। বিকল্প রুজির পথ খুলে গেলে পরিশ্রমের ভাঁজ পড়া অনেক মুখে খুশির হাসি ফুটবে।
দোলের রং যদি ‘মর্মে লাগে’, স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘সকল কর্মে লাগে’, সেই তো ভাল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy