‘ঘটি-বাঁটি নাইলো.....রঙ্গোবতি, ও মোর রঙ্গোবতি...’ গাইতে গাইতে প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে মিলিয়ে গেল সে।
গোটা বনগাঁ লাইন তাকে নিয়েই তোলপাড়। শুক্রবার রাতে বারাসত স্টেশনে এসে দাঁড়ানো বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকালের গার্ডের কেবিনের দরজা খোলা পেয়েই ট্রেন চালাতে উঠে পড়েছিল সে। দরজা এঁটে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল মিনিট কুড়ি। ট্রেন অবশ্য নড়েনি। কোনও ভাবেই নিরস্ত করতে না পেরে শেষমেশ দরজার লক ভেঙে তাকে নামিয়ে নিয়ে যায় রেল পুলিশ।
রাতেই শিয়ালদহ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বছর তিরিশের সেই ট্রেন-খ্যাপাকে। কিন্তু গলদ যার মস্তিষ্কে, তাকে আটকে রেখে পুলিশ করবেটা কী? তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় প্ল্যাটফর্মেই। ছাড়া পেয়েই সে ওড়িয়া ভাষায় গান ধরে, ‘রঙ্গোবতি, ও রঙ্গোবতি!’ আরপিএফের এক কর্তার কথায়, ‘‘পাগলের মতিগতি আর কী! এত কাণ্ডের পরে কখনও সে হাসছে, কখনও গান গাইছে। ছেড়ে দিতেই ওই গান গাইতে গাইতেই কোথায়
চলে গেল!’’
তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। শুক্রবার রাতে প্রথমে যতটা আতঙ্কে ট্রেন নেমে পড়েছিলেন যাত্রীরা, পরে তার চেয়ে মজা পেয়েছেন ঢের বেশি। ওই ট্রেনের যাত্রী ঠাকুরনগরের সুভাষ বিশ্বাস এ দিন বললেন, ‘‘বাইরে থেকে চিৎকার শুনি, নেমে পড়ুন, নেমে পড়ুন, ট্রেন হাইজ্যাক হয়েছে! কোনও মতে ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ি। নেমে দেখি, এ তো পাগলের কাণ্ড। সে যে কী মজা, এখনও ভাবলে হাসি পাচ্ছে।’’ আর এক যাত্রী, মছলন্দপুরের বাসিন্দা, পেশায় নৈশপ্রহরী উত্তম রায় তো হেসেই খুন। পরে অবশ্য চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘‘কাল বাধা পেয়ে কাজেই যাইনি। ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফিরে এসেছি।
যদি সত্যিই লোকটা ট্রেন চালিয়ে দিত....তা হলে!’’
হেসে ফেললেন বারাসত স্টেশনের এক হকারও। বললেন, ‘‘সে এক ব্যাপার! একশো টাকা, পাঁচশো টাকার নোট দেখিয়ে বলছি, ‘ভাই দরজাটা খুলে দে।’ সে রাজা-বাদশার মতো মাথা নাড়ছে আর বলছে ‘আজ আমি ট্রেন চালাবই।’ সামনের হ্যান্ডেল-ফ্যান্ডেল যা পাচ্ছিল, ঘুরিয়ে যাচ্ছিল আর সুর করে বলছিল ‘‘ভ্রুউউউউউম..... বোঁওওওওবো! ভাবুন এক বার!’’ শোনা গেল, যত বার দরজা খুলতে বলা হচ্ছিল, ততই নাকি তেতে উঠছিল সে।
শনিবারেও চলন্ত লোকাল ট্রেনের আড্ডা সরগরম এই ট্রেন-খ্যাপাকে নিয়ে। অনেকেই এ দিন বারাসত স্টেশনের হকার ও রেলকর্মীদের কাছে গোটা গল্পটা রসিয়ে রসিয়ে শুনতে চেয়েছেন। অত্যুৎসাহী কেউ কেউ আবার জানতে চেয়েছেন, দরজা খুলে রেখে গার্ডসাহেব ঠিক কী করতে নেমে গিয়েছিলেন!
রেল অবশ্য জানিয়েছে, গার্ডের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ প্রাথমিক তদন্ত বলছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই তিনি ট্রেন থেকে নেমেছিলেন। গোটা ঘটনাটি তাই সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক কর্তা। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র শনিবার শুধু বলেছেন, ‘‘বারাসতে গার্ড ব্যক্তিগত কাজে নেমেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর চলছে।’’
যাত্রীদের অনেকে অবশ্য কিঞ্চিৎ ‘সিরিয়াস’! তাঁদের প্রশ্ন, ‘টয়লেট’ পেতেই পারে, কিন্তু কেবিনের দরজাটা কেন লক করে যাননি গার্ডসাহেব? যদি ওই ‘পাগলের’ হাতে সত্যিই অঘটন কিছু ঘটে যেত, তা হলে তার দায় নিত কে? আর রেল পুলিশই বা কী করছিল? এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রেল পুলিশের কর্তারা। বারাসতের স্টেশন মাস্টার প্রদীপ পালও মুখ খোলেননি।