Advertisement
E-Paper

মদের গন্ধে ধাবায় আসে হাতিরাও

অনেক গল্পের ছোট্ট পৃথিবী, ধাবা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন।সব ধাবা এক বার, ‘ধর্মার ধাবা’ বারবার!— শিলিগুড়ি থেকে অসমগামী জাতীয় সড়কে নিত্য যাতায়াতকারী ট্রাকচালকদের আড্ডায় কান পাতলেই এমন কথাই শোনা যায়। ধাবা মালিকের আসল নাম কিন্তু ধর্মা নয়। মদ পেটে পড়লে তাঁর আচরণ হয়ে যায় বলিউড তারকা ধর্মেন্দ্রর মতো।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৩৬
দিনে-রাতে সবসময়েই জমজমাট ময়নাগুড়ির ঝাঝাঙ্গির ধাবা। দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।

দিনে-রাতে সবসময়েই জমজমাট ময়নাগুড়ির ঝাঝাঙ্গির ধাবা। দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।

সব ধাবা এক বার, ‘ধর্মার ধাবা’ বারবার!— শিলিগুড়ি থেকে অসমগামী জাতীয় সড়কে নিত্য যাতায়াতকারী ট্রাকচালকদের আড্ডায় কান পাতলেই এমন কথাই শোনা যায়।

ধাবা মালিকের আসল নাম কিন্তু ধর্মা নয়। মদ পেটে পড়লে তাঁর আচরণ হয়ে যায় বলিউড তারকা ধর্মেন্দ্রর মতো। তাই আদর করে তাঁকে ধর্মা বলে ডাকেন ‘রেগুলার’রা, অর্থাৎ যাঁরা ফি হপ্তায় অন্তত এক দিন এখানে আসেন। আর যাঁরা মাঝেমধ্যে আসেন, তাঁরা হলেন ‘গেস্ট’।

ডুয়ার্স থেকে অসমের দিকে কিছুটা গেলেই ধাবাটি। বাইরে সাইনবোর্ডে নীল কালিতে লেখা ‘রুটি-তড়কা-মাংস-ভাত’। জাতীয় সড়কের ধারে প্রায় দু’বিঘা জায়গা জুড়ে ধাবা। সামনে খাটিয়া। ভেতরে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল। রাত ১২টায় গাড়ি থামিয়ে সেখানে বসতেই অল্পবয়সী একটি ছেলে ঠকাস করে দু’টো গ্লাস নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বলল, ‘‘দেখে তো মনে হচ্ছে বিলাতি খাবেন। রাম না হুইস্কি?’’

‘‘গরম চা পাওয়া যাবে?’’

ভূত দেখার মতো চমকে উঠে সে বলল, ‘‘মিলবে স্যর। আপনারা পুলিশ না সাইজের লোক!’’

পুলিশ না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ‘সাইজ’ কী? পাশের খাটিয়ায় বসা তিন জন হো হো করে হেসে উঠলেন। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘সাইজ হল এক্সাইজ। মানে আপনারা আবগারি বিভাগের লোক কি না, সেটা বুঝতে চায়। ধর্মা এল বলে!’’

বলতে বলতেই বেটেখাটো চেহারার মধ্যবয়সী এক জন হাজির। আমাদের জরিপ করে বললেন, ‘‘নতুন গেস্ট মনে হচ্ছে। ধর্মার ধাবায় ওয়েলকাম। নিশ্চিন্তে বসে খান। এখানে কেউ আসবে না। না পুলিশ, না গুন্ডা।” বলেই অট্টহাসি।

তত ক্ষণে ধাবার অদূরে জাতীয় সড়কে দাঁড়িয়ে গিয়েছে পুলিশের জিপ। ধর্মা চলে গেলেন সে দিকে। মিনিট পাঁচেক কথাবার্তার পরে ওখান থেকেই হাঁক পাড়লেন, ‘‘অনিল, ১০ তন্দুরি, দো টাইট তড়কা, ২ চিকেন তন্দুরি, দো পিস ফিস ফ্রাই জলদি প্যাক কর দো। ২ কোয়ার্টার বিপি ভেজ দো। জলদি!’’

দূরপাল্লার যাত্রীদের চোখের সামনে এমন দৃশ্য হামেশাই ঘটছে। শিলিগুড়ি-গুয়াহাটি রুটের এই পথে নিয়মিত বাসযাত্রী যাঁরা, তাঁরা এমন দেখেশুনে অভ্যস্ত। এমনকী, তাঁদের জন্যও রয়েছে নানা বন্দোবস্ত। তার কতটা বেআইনি এবং কী পরিমাণ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আর সে জন্য ধাবা-মালিকদের অনেককেই বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়। অভিযোগ, পুলিশ-আবগারি-প্রশাসনিক পর্যায়ের অফিসার-কর্মীদের একাংশকে তুষ্ট করেই চালাতে হয় ধাবা। খুশি রাখতে হয় এলাকার নেতাদেরও। কয়েক জন ধাবা মালিকের কাছ থেকে শোনা গেল, অমুক জেলা নেতা ফোনে বিপুল পরিমাণ খাদ্য-পানীয় চেয়ে পাঠিয়েছেন রাতবিরেতে, আর সেটা পৌঁছেও দিতে হয়েছে!

এর পরেও কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন না ধাবা মালিকরা। কারণ, ভোর রাতের একদল আগন্তুক। দুরন্ত গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে ৫-৬ জন মিলে হাজির হয় তারা। বিনা কারণে কর্মীদের মারধর করে খাবারদাবার খেয়ে জোর করে টাকা নিয়ে চলে যায় তারা। এদের অনেকেই অসমের জঙ্গি দলের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ ধাবার মালিক ও কর্মীদের।

ধাবা মালিকদের বক্তব্য, গাড়ি চোরদের পাণ্ডা, কয়লার চোরাচালানকারী, বাংলাদেশের চোরাকারবারি— ধাবায় তো অবাধ গতিবিধি সকলেরই। কিন্তু আসল ভয়টা ওই ‘জঙ্গিদের’ নিয়ে। এক বার তো এক রাঁধুনির রান্না ভাল লাগায় তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। ব্রহ্মপুত্রের চরে গোপন ডেরায় সাত দিন তাঁকে রেখে নিজেদের রাঁধুনিকে রান্না শিখিয়ে নিয়েছিল!

কোচবিহারের চ্যাংরাবান্ধা, মাথাভাঙার হিন্দুস্থান মোড়, সোনাপুর, তুফানগঞ্জ এবং দিনহাটা যাওয়ার রাস্তাতেও একাধিক ধাবা রয়েছে, যেগুলিতে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই মদ বিক্রি হয়। তা নিয়ে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে সরব হওয়ার সাহস পান না। অভিযোগ, বাম আমলে সেই সময়ের দাপুটে নেতাদের সঙ্গে ওই বেআইনি কারবারিদের ওঠাবসা ছিল। জমানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে আনুগত্যও। অভিযোগ, সব জেনেও তাই পুলিশের মুখে কুলুপ।

রাতের ধাবা মানেই ঘটনার ঘনঘটা।

কখনও বোমার শব্দে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় রুটি-তড়কা-চিকেনের আয়োজন। আবার কখনও পুলিশি অভিযানে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে হাত-পা ভাঙার ঘটনাও কম নেই। এমন নানা পেশাদারি ঝক্কি সামলানোর কৌশল জানতে হয় ধাবা-মালিকদের প্রায় সকলকেই। কিন্তু হানাদার যদি মানুষ না হয়, তা হলে?

হ্যাঁ, ডুয়ার্সের জঙ্গলঘেরা এলাকায় রাতবিরেতে হাতির হানা এখন জলভাত। আর তাতেই মাথায় হাত পড়েছে ধাবা-মালিকদের।

চলতি মাসেই ডুয়ার্সের বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প লাগোয়া দমনপুরের কাছে এক ধাবার ঘটনার বিবরণ দেওয়া যাক। তখন সবে রাত ১০টা। ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা ধাবায় লোক সমাগম কম নেই। কোথাও খাটিয়ায় ধোঁয়া ওটা তড়কা-রুটির প্লেট। আবার কোথাও পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চাঁদনি রাতের কুয়াশা ঘেরা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে এক দল যুবক। আচমকাই হুঙ্কারে কেঁপে উঠল চারদিক। রুটি-তড়কার প্লেট ফেলে কেউ ছুটে গিয়ে তড়িঘড়ি স্টার্ট দিলেন গাড়িতে। কেউ গিয়ে লুকোলেন উনুনের পিছনে। আবার কয়েক জন ভয়ে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গায়ে মাংসের ঝোল মাখামাখি। তত ক্ষণে ছানাপোনা নিয়ে ধাবায় হাজির হাতির পাল!

রুটি সেঁকা ছেড়ে পাচক মুহূর্তে মশাল জ্বালিয়ে ফেলেছেন। মশলা মাখা হাতেই একের পর এক পটকা ছুঁড়ছে কমবয়সী ধাবা-কর্মীরা। কোনওটা ফাটছে। কোনওটা ফাটছে না। প্রায় মিনিট ১৫ হাতির পাল দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। ধাবায় অবশ্য আসর আর জমল না। কারণ, তত ক্ষণে খবর পেয়ে এসে গিয়েছেন বনকর্মীরা। বিস্তর চোটপাট করে তাঁরা ধাবা বন্ধ করিয়ে চলে গেলেন। আলিপুরদুয়ারের যে যুবকেরা আগুন জ্বালিয়ে গিটার নিয়ে ‘ক্যাম্প ফায়ারে’ মেতেছিলেন, তাঁরাও কোনও মতে গাড়িতে উঠে উধাও হয়ে গেলেন।

তাই দুঃখ করছিলেন ওই এলাকার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য তথা ধাবার মালিক বাণীকান্ত মারাক। তিন পুরষ ধরে ধাবা চালাচ্ছেন তাঁরা। বলছিলেন, ‘‘আগে দিনরাত ভিড় হতো। ইদানীং হাতির হানাদারি বেড়ে গিয়েছে বলে সন্ধ্যার পরে আর লোকজন তেমন হয় না। কী যে করি!’’

কোথাও ধাবার চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। আবার কোথাও ধাবা মালিকই নিরামিষের দিকে ঝুঁকছেন। যেমন ধরা যাক ঝাঝাঙ্গি-র কথা।

ঝাঝাঙ্গির ব্যাপারই আলাদা।

মদ, নেশার আসর, দেহ ব্যবসার ছোঁয়াচ বাঁচাতে এখন ঝাঝাঙ্গি হল নিরামিষ ধাবা। মাছ-মাংস মিলবে না। কিন্তু, ডিম, পেঁয়াজ মেলে। না হলে তরকা জমবে কী করে! মাঝরাতেও মিলবে গরম দুধ। ধাবার পেছনেই রয়েছে খাটাল। সেখান থেকে খাটি দুধ এনে তৈরি হয় রাবড়ি, পেড়া। রয়েছে জাম্বো আকারের লাড্ডু। সব মিলিয়ে রাতভর জমজমাট ঝাঝাঙ্গি।

ওড়িষ্যার গোপালপুরের মাছ ব্যবসায়ী থেকে শিলংয়ের দারচিনির পাইকার, সকলের মুখেই শোনা যায় নামটি। ময়নাগুড়ি থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়কের ধারে যে ধাবায় নিশুতি রাতে বসে আজও শোনা যায় শেয়ালের হুক্কা-হুয়া। রাতভর আলোয় ঝলমল ঝাঝাঙ্গিতে কি না মেলে! ৪০টি শৌচাগার, স্নানাগার, শ’দেড়েক দোকান।

ধাবাটিকে আগলেও রাখেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। সারারাত খোলা থাকায় ধাবায় ঝুটঝামেলা লেগেই থাকত। মদ্যপদের হুল্লোড়, তোলাবাজদের হাঙ্গামা ছিল প্রতি রাতের ঘটনা। গোলমাল বাড়তে থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তৈরি করেন, ‘ঝাঝাঙ্গি হোটেল ব্যবসায়ী সমিতি’। সিদ্ধান্ত হয় ধাবার সামনে পান-সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়র দোকানগুলিও রাতভর খোলা থাকবে। ধাবায় কোনও গোলমাল দেখলেই ব্যবসায়ীরা জোট বেধে মোকাবিলা করবেন। নেশাগ্রস্তদের আড্ডা ঠেকাতে ধাবাটিও আমিষ থেকে নিরামিষে বদলে যায়। তবে ডিম আর পেঁয়াজ অবশ্য এখনও তড়কার সঙ্গ ছাড়েনি।

আসলে একটা নদীর নাম হল ঝাঝাঙ্গি। ধূ ধূ ধান খেতের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে সে। অনেকের দাবি, এই এলাকার বাসিন্দাদের মুখে পাঞ্জাবির তরকার স্বাদ এনে দিয়েছিল এই নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ধাবা। নদীর নামেই ধাবার-ও নাম ঝাঝাঙ্গি। এক সময়ে ধাবায় বসতে দেওয়া হতো শক্ত দড়ি বাঁধা খাটিয়ায়। খাটিয়ার উপরে পেতে দেওয়া হতো কাঠের পাটাতন। সেখানেই পরিবেশন করা হতো গরম খাবার।

আশির দশকে তৈরি হওয়া ধাবা-ই, বদলে দিয়েছে লাগোয়া এলাকার চালচিত্র। এখন সারারাত সোডিয়াম আলোয় চকচক করে জাতীয় সড়কের পাশের ধাবা এলাকা। দুরপাল্লার পণ্যবাহী ট্রাচালকদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা হিসেবে পরিচিত ঝাঝাঙ্গি ধাবা।

মাটি লেপা প্রায় বারোটি চুল্লিতে সবসময়ে আগুনের আঁচ গমগম করছে। কোনটায় তরকার ডাল ফুটছে, কোনটায় রুটি সেঁকা হচ্ছে। দিন-রাত মিলিয়ে প্রতিদিন ৮০ জন কর্মী ধাবায় কাজ করেন। একসময়ে শুধু তরকা খাওয়ার জন্যই জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়িতে থেকে বাসিন্দারা ঝাঝাঙ্গির ধাবায় যেতেন। এখন প্রায় সর্বত্রই পাঞ্জাবি খানা মেলে। তরকা তো পাড়ার ছোট্ট হোটেলেও চাইলেই মিলে যায়। তবু ঝাঝাঙ্গির সামনের ভিড় কমেনি।

ঝাঝাঙ্গির ঘটনা ব্যতিক্রম। বেশির ভাগ জায়গায় ধাবায় চলে গোপনে মদের কারবার। তাতে বিপদও ঘটে যায়। বছর আটেক বালুরঘাটের চকভৃগুর রেলস্টেশন পাড়ার একটি ধাবায় ভেজাল মদ খেয়ে এক মহিলা সহ ৯ জনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। কারও শাস্তি হয়নি। সেই মামলা আজও চলছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনেক দাবার চেয়াহার বদলে গিয়েছে।

পানশালার লাইসেন্সও মিলছে। আবগারি দফতরের একাধিক অফিসার জানিয়েছেন, ধাবায় যে মদ বিক্রি হয়, তা কারও অজানা নয়। সে জন্য ধাবাগুলির তরফে চাইলে ও প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করলে মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়েছে। ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের অনেকেই জানান, পাহাড়ের রাস্তায় সেবক ও লাগোয়া এলাকা ও ডুয়ার্সের পথে যে সব ধাবা রয়েছে সেগুলির চেহারা ফেরাতে সরকারি স্তরেও চিন্তাভাবনা হোক। কারণ, ধাবার আধুনিকীকরণ হলে সেখানে আশেপাশের নানা এলাকার বাসিন্দাদের তো বটেই, পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে।

state news elephant comes for alcohol
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy