Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

ছেলে সত্যিই ফিরেছে! ঘোর কাটছে না মায়ের

কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই ছেলেটা ফিরে এল তবে! ফোনটা কানে নিয়ে মা ডাকটা শুনেই গলা বুজে এসেছিল বেবিরানি বিশ্বাসের। নিজেকে একটু সামলে আঁচলে চোখ মুছে বলেন, ‘‘সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস? খেয়ে নে।’’ উত্তর এসেছে, ‘‘আমি খেয়েছি, তুমি ঠিক থেকো।’’

বিতান ভট্টাচার্য ও তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:০৫
Share: Save:

কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই ছেলেটা ফিরে এল তবে! ফোনটা কানে নিয়ে মা ডাকটা শুনেই গলা বুজে এসেছিল বেবিরানি বিশ্বাসের। নিজেকে একটু সামলে আঁচলে চোখ মুছে বলেন, ‘‘সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস? খেয়ে নে।’’ উত্তর এসেছে, ‘‘আমি খেয়েছি, তুমি ঠিক থেকো।’’

নৈহাটি-হাবড়া রোডের ধারে কুলিয়াগড়। ধানখেতের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে কাঁচা রাস্তা। সে পথে এগিয়ে গোটাকয়েক পুকুর, সুপুরিবাগান, কলাবাগান পেরিয়ে পৌঁছনো যায় প্লাস্টার না-হওয়া ছোট্ট একতলা বাড়িটিতে। এখান থেকেই মাস সাতেক আগে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন বাড়ির ছোট ছেলে জয়ন্ত বিশ্বাস। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে জমিও বিক্রি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথবাবু।

গত ১৫ মে, দিল্লির এক এজেন্সির মাধ্যমে, মুম্বই হয়ে রিয়াধে পৌঁছন জয়ন্ত। সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরে পা রেখেই বদলে যায় সব কিছু। শুরু হয় দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। এক সৌদি ব্যবসায়ীর কাছে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যান তিনি। মাস ছয় পরে জানাজানি হয় তাঁর উপর চলা নির্মম অত্যাচারের কথা।

বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে জয়ন্তর পরিবার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বেগ জানিয়ে দিল্লিতে যোগাযোগ করেন। জয়ন্তকে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জয়ন্তকে মুম্বই পাঠানোর ব্যবস্থা করে সৌদি সরকার। বুধবারই মুম্বই হয়ে কলকাতায় পৌঁছেছেন জয়ন্ত। বিমানবন্দর থেকে নৈহাটির বাড়িতে ফিরবেন, এমনটাই ঠিক ছিল প্রথমে। পাড়া-পড়শির ভিড়ও ছিল তাই। কিন্তু এ কোন জয়ন্ত! ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটার চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক। আসার আগেও মারধর করেছে ‘মালিক’। ভাইয়ের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখার পর জয়ন্তকে কলকাতায় চিকিৎসককে দেখিয়ে নিজের কাছে দু’-এক দিন রেখে দেবেন মনস্থ করেন গৌরী বিশ্বাস। তাই দিদির যোধপুর পার্কের বাড়িতেই থেকে গিয়েছেন জয়ন্ত। বিমানবন্দরে নেমে মাকে ফোন করেছিলেন তিনি। মা বলে ডাকার পরে চোখ ভিজেছে তাঁরও।

জীবনে কখনও মরুভূমি দেখেননি বেবিদেবী। শুনেছিলেন, মরুভূমির মধ্যে আলো-হাওয়াহীন একটা ঘরে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে ছেলে। উটকে খাওয়ানোর পাত্র থেকেই জল খেতে হচ্ছে। তার পর থেকে এই ক’দিন কী করে যে কেটেছে! ছেলে বাড়ি ফিরলে আগে নিজের হাতে ভাত খাওয়াবেন, তবেই শান্তি বেবিদেবীর। জয়ন্তর বাবা অসুস্থ শরীরে ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েছিলেন টাকা তুলতে। বাজার করে ছেলের জন্য মাছ আর সব্জি কিনবেন বলে। কিন্তু ছেলে নৈহাটি ফিরছে না খবর পেয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথবাবু।

কলকাতার যোধপুর পার্কে জয়ন্তর দিদি গৌরীদেবীর বাড়িতে এ দিন উৎসবের মেজাজ। সৌদি আরবে নিজের দুরবস্থার কথা এই জেঠতুতো দিদিকেই সকলের আগে জানিয়েছিলেন জয়ন্ত। তার পর থেকেই গৌরীদেবী লাগাতার চেষ্টা করে গিয়েছেন ভাইকে দেশে ফেরানোর। যোগাযোগ করে গিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রক, সৌদি হাইকমিশন, সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে। এ দিন ভাই ফিরতেই মনে হয়েছে, এত দিনের লড়াই শেষ হল। বললেন, ‘‘খুব ভয়ে থাকতাম। ও যে সুস্থ ফিরে এসেছে, সেটাই সব চেয়ে বড় কথা।’’

জয়ন্তর দাদা প্রশান্ত বিশ্বাস বললেন, ‘‘ভাই খুব আদরের। ওর মাথা ভাল ছিল বলে আমি নিজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ওকে পড়িয়েছি। ও যখন বিদেশ গেল, আনন্দের সীমা ছিল না। ভাবতেও পারিনি, চাকরি করতে গিয়ে এমনটা হবে।’’ তিনি জানালেন, জয়ন্ত ভাল নেই এটা জানার পর থেকেই যে এজেন্সির মাধ্যমে তিনি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। জয়ন্তকে ফেরানোর আশ্বাস দিয়ে দফায় দফায় লাখ পাঁচেক টাকা নিয়ে নিয়েছে ওই এজেন্সি। কিন্তু পুরোটাই যে ধাপ্পাবাজি, তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়।

দিদি গৌরীদেবী জানালেন, ওই এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করবেন তাঁরা। তবে ভাইকে আগে সুস্থ করে তোলাই এখন তাঁর প্রথম চিন্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saudi arabia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE