Advertisement
০৩ মে ২০২৪

জঙ্গলমহলের নাইটিঙ্গল

ঝুমুর গানের কোকিলকণ্ঠী তিনি। কিন্তু আঞ্চলিক গানের গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়নি তাঁকে। কলাবনির বনে তাঁর হারিয়ে যাওয়া নাকছাবিটা খুঁজতে এখনও আগ্রহী কলকাতা থেকে বাংলাদেশ। ইন্দ্রাণী মাহাতোর সুর সফরের সঙ্গী হলেন কিংশুক গুপ্তঝুমুর গানের কোকিলকণ্ঠী তিনি। কিন্তু আঞ্চলিক গানের গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়নি তাঁকে। কলাবনির বনে তাঁর হারিয়ে যাওয়া নাকছাবিটা খুঁজতে এখনও আগ্রহী কলকাতা থেকে বাংলাদেশ। ইন্দ্রাণী মাহাতোর সুর সফরের সঙ্গী হলেন কিংশুক গুপ্ত

ইন্দ্রাণী মাহাতো

ইন্দ্রাণী মাহাতো

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৮ ০১:২৭
Share: Save:

প্রশ্ন: জন্মের দিনটাই বোধহয় আপনার যাত্রাপথ ঠিক করে দিয়েছিল?

উত্তর: নিশ্চয় নামের কথা বলছেন? ঠিকই। ভাদ্র মাসে ইন্দ্রপুজোর দিনে আমার জন্ম। তাই অভিভাবকেরা নাম দেন ইন্দ্রাণী। রাজধানী এবং সংলগ্ন জেলায় ইন্দ্রপুজোর তেমন চল আছে বলে মনে হয় না। সেই নামে সন্তানের নাম! একটু আঞ্চলিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।

প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামের ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। গানের দিকে ঝুঁকলেন কীভাবে?

উত্তর: বাবা লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা শান্তিলতাদেবী এখনও ঘর সংসার সামলাতেই ব্যস্ত। চার বোনের মধ্যে আমিই বড়। পরিবারে কিন্তু গানের চর্চা ছিলই। প্রথম ঝুমুর গান শিখি সেই ছোটবেলায়। পিসি অঞ্জলি মাহাতোর কাছে। পিসি এখন জামশেদপুর রেডিও-র নিয়মিত শিল্পী। তবে গানের কান তৈরি হয়েছিল ঠাকুরদার জন্য।

প্রশ্ন: ঠাকুরদা মানে তো ‘রেডিও কালী’?

উত্তর: ঠাকুরদার নাম কিন্তু কালীপদ মাহাতো। ছিলেন আমিন। ঝাড়গ্রামে তাঁর রেডিও-র দোকান ছিল বলে লোকে ‘রেডিও কালী’ নাম দিয়েছিল। বাড়িতে রেডিও-র গান শুনেই বড় হওয়া। সেই সঙ্গে সুরের জগতে মিলেমিশে যাওয়া।

প্রশ্ন: রেডিও-র গানে গুনগুন করে কানের সঙ্গে গলাও সাধা হতো নিশ্চয়?

উত্তর: সে তো বটেই। তবে আঞ্চলিক গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল মা-ঠাকুমা। তাদের থেকেই শিখেছিলাম কুড়মালি সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ ‘জাওয়া’, ‘করম’, ‘বাঁদনা’ ও ‘মকর’ পরবের গান। এ ছাড়াও কুড়মিদের বিয়ের গান ‘বিহাগীত’ও শুনেছি ছোটবেলা থেকে।

প্রশ্ন: ছোটবেলার সুরশিক্ষা কাজে লেগেছিল?

উত্তর: খুবই। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ হয়। নৃতত্ত্ববিদ পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো এবং লোকগীতিশিল্পী স্বপন বসুর সঙ্গে। সালটা ১৯৭৮।

প্রশ্ন: পড়াশোনা তো ঝাড়গ্রামেই?

উত্তর: ঝাড়গ্রাম, কলকাতা মিলিয়ে। প্রাথমিক স্কুল ঝাড়গ্রাম বাণীভবন। এরপর ঝাড়গ্রাম শহরের রানি বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিএ এবং এম এ।

প্রশ্ন: প্রথম গানের ক্যাসেট কবে?

উত্তর: এমএ পড়ার সময়ে প্রথম গানের ক্যাসেট বেরোয়। ১৯৯৮ সালে। কলকাতার একটি সংস্থা থেকে বেরিয়েছিল ‘ঝুমুর দেশের ঝুমুর গানে’ নামে সংকলন। ঝুমুর গানের ওটাই প্রথম ক্যাসেট। কিন্তু প্রচলিত ঝুমুর গানগুলো তেমন জনপ্রিয় হয়নি।

প্রশ্ন: জনপ্রিয়তার নাগাল পেতে কি অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল?
উত্তর: আমার সৌভাগ্য বেশিদিন করতে হয়নি। বছর দুয়েকের মতো। ১৯৯৯ সালে এমএ পাশ করি। ২০০০ সালে ঝাড়গ্রামের এক ক্যাসে়ট সংস্থার কর্ণধার গণেশ দাস ঝুমুর গানের অ্যালব্যাম প্রকাশ করতে আগ্রহী হন। ঝুমুরশিল্পী লক্ষ্মীকান্ত মাহাতোর সঙ্গে বেরোয় ‘ক্যেমনে ভুলিব তর কথা’।

প্রশ্ন: ওই অ্যালবামেই তো ছিল সুপারডুপার হিট ‘আমার নাকফুলটা হাঁরাঞ গেল কলাবনির বনে গো কলাবনির বনে’?

উত্তর: গানটা কিন্তু আমার আর লক্ষ্মীকান্ত মাহাতোর দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া। লোকে যে গানটা এত পছন্দ করবেন ভাবতে পারিনি। কলকাতাতেও সমান জনপ্রিয় হয়েছিল গানটা। গানের গীতিকার ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট কুড়মালি কবি ললিতমোহন মাহাতো। সুরকার লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো।

মেজাজে: ঝুমুর গানের ডালি দিয়ে মঞ্চ মাতান ইন্দ্রাণীদেবী । নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: ঝুমুর গানের প্রসারে তো গণেশ দাসের ভূমিকা আছে?

উত্তর: একসময়ে ওঁর ক্যাসেট কোম্পানি বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওডিশায় ঝুমুর গানের প্রসারে দারুণ সাড়া ফেলেছিল।

প্রশ্ন: ‘নাকফুলের’ পরে পেশাদার মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করলেন। একটু পেশাদার মঞ্চের কথা বলুন।

উত্তর: গত ১৮ বছরে ওডিশা, ঝাড়খণ্ড এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সারা বছর ঝুমুর গানের অনুষ্ঠান করি। লখনউ, দিল্লি, সিকিমের সিংগিক, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝুমুর গানের অনুষ্ঠান করেছি।

প্রশ্ন: এ পর্যন্ত কতগুলো সিডি বেরিয়েছে?

উত্তর: গানের অ্যালবামের সংখ্যা ১২। ‘ঝুড়গুড়া (চোরকাঁটা) লাগিছে হামার সাধের শাড়িতে’ বা ‘প্যাঠে নাই দানাপানি, কাঁন্দে কলের ছানা/কন বাইনে বাজনা বাজাঞ, হাথুরাঞ রাতকানা’ গানগুলো জনপ্রিয় হয়।

প্রশ্ন: মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশনায় বেশ বদল এনেছেন এখন?

উত্তর: আগে ঝুমুর গান শুনতেই দলে দলে শ্রোতা আসতেন। এখন আঙ্গিক বদলেছে। তাই গানের সঙ্গে নাচও হয়। ধামসা, মাদল, ঢোল, জুড়ি নাকাড়ার মতো সাবেক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সিন্থেসাইজারও বাজে। যন্ত্রী ও সহযোগীর সংখ্যা ২৫ জন। কয়েকজন নৃত্যশিল্পীও আছেন।

প্রশ্ন: রাঢ়ভূমের পরব মানেই ঝুমুর গান। ‘হাইরেট’ শিল্পী ইন্দ্রাণীর ডেট পেতে তো সমস্যা হয়?

উত্তর: অনেককেই ফিরিয়ে দিতে হয়। সব অনুষ্ঠান আমি করব এই মানসিকতা নেই। নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। জামবনির সমীর মাহাতো, লোধাশুলির পরিতোষ মাহাতো, হদহদির বিকাশ সিংহদেব, বাকড়ার অনিমা মাহাতো, কলাইকুণ্ডার অঞ্জলি মাহাতোরা খুবই ভাল ঝুমুর গাইছেন।

প্রশ্ন: ঝুমুর গানে তো প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। কারও কাছে নাড়া বাঁধেননি?

উত্তর: না, সেই অর্থে হয়নি। অগ্রজ ঝুমুর শিল্পী লক্ষ্মীকান্ত মাহাতোর কাছে সময় সুযোগ মতো ঝুমুর গান শিখেছি। আমার সম্পর্কে জেঠামশাই পুরুলিয়ার নৃতত্ত্ববিদ পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর কাছেও প্রচলিত ঝুমুর গান শিখেছি। ‘ঝুমুর সম্রাট’ বলে পরিচিত বিজয় মাহাতোকে তো আমি ‘বিজয়কাকু’ বলি। কোনও দিন গান শেখাতে চাননি। তাঁর গান শুনে সমৃদ্ধ হই। উনি পরোক্ষে আমার ‘ঝুমুর গানের গুরু’।

প্রশ্ন: রাজ্য সরকারের লোকশিল্প প্রসার প্রকল্পের নথিভুক্ত শিল্পী আপনি?

উত্তর: গত বছর রাজ্য সরকারের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র আদি ঝুমুরের সংকলনের সিডি প্রকাশ করেছে। ‘লালমাটি শালবন’ সিডিতে চারটি প্রচলিত ঝুমুর গান রয়েছে।

প্রশ্ন: কোনও আক্ষেপ?

উত্তর: অনেক শেখা বাকি। বিজয়কাকুর আখড়ায় গান শেখার সুযোগ না পাওয়ার দুঃখ আজীবন থেকে যাবে। ঝুমুর গানের প্রবাদ পুরুষ জীবনে কাউকে গান শেখাননি।

প্রশ্ন: এখনকার ঝুমুর গান নিয়ে কিছু বলবেন?

উত্তর: ইদানীং শিল্পীদের একাংশ ঝুমুরের সুরে কুরুচিকর কিছু গানকে ঝুমুর বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। এটা ভীষণ কষ্ট দেয়।

প্রশ্ন: এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

উত্তর: ঝুমুর মানে সহজিয়া সুরে জঙ্গলমহলের মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা। পুরুলিয়ার সুনীল মাহাতোর লেখা ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন পালাব পালাব মন’ বা ঝাড়গ্রামের কবি ভবতোষ শতপথীর ‘জল ভরা মেঘ আর কাজল পরা রানি/ হামার ঘরে বাদল, বাহিরে বাদল/ ভাতের টানাটানি’তে সেই জীবনযাত্রারই পরিচয় মেলে। ভবতোষবাবুর লেখা ‘আকাল বছর আইল ঝড়/ উড়াই লিল চালের খড়’ জঙ্গলমহলের জীবনের কথা বলে। গানগুলো বিজয় মাহাতোর গলায় বিখ্যাত হয়েছিল। এই সব গান মণিমুক্তোর মতো। অনুষ্ঠানে নিজের গানের সঙ্গে এঁদের গানও গাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE