Advertisement
০৫ মে ২০২৪

গতানুগতিক চাষ ছেড়ে আমে মজে চাষি, বাড়ছে আশঙ্কাও

দু’দিন আগেও যেখানে শরতের মৃদু-মন্দ হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিত ধানের শিষ, সেখানে আজ রাজত্ব করছে ল্যাংড়া গোলাপখাস, হিমসাগরেরা। পাকা ধান ঘরে তোলার বদলে এখন পাইকার ডেকে বাগান নিলাম করার অপেক্ষায় দিন গুণছেন চাষিরা।

আম বাছতে ব্যস্ত চাষি।— নিজস্ব চিত্র

আম বাছতে ব্যস্ত চাষি।— নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৩:৪২
Share: Save:

দু’দিন আগেও যেখানে শরতের মৃদু-মন্দ হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিত ধানের শিষ, সেখানে আজ রাজত্ব করছে ল্যাংড়া গোলাপখাস, হিমসাগরেরা। পাকা ধান ঘরে তোলার বদলে এখন পাইকার ডেকে বাগান নিলাম করার অপেক্ষায় দিন গুণছেন চাষিরা। কোথাওবা ঝুড়ি ভরে ব্যবসায়ীর হাতে ইতিমধ্যেই তা তুলে দিয়েছেন ‘ফসল’।

প্রথাগত চাষে লাভ তেমন নেই। উল্টে বেড়েছে চাষের খরচ। সঙ্গে রয়েছে ফলনের অনিশ্চয়তাও। বাড়তি দুটো কাঁচা পয়সার মুখ দেখতে গতানুগতিক চাষ ছেড়ে তাই ফল চাষে মন দিয়েছেন চুপি, কাষ্ঠশালি-সহ পূর্বস্থলীর বিভিন্ন এলাকার চাষিরা। অনেকে নানা ধরনের চাষে ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নিচ্ছেন। তাই বাপ-দাদার আমলের পারিবারিক চাষের জমি নিঃশব্দে বদলে যাচ্ছে আম বাগানে। শুধু আমই নয় পেয়ারা, বায়ো কুল, কলা বাগানও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কৃষি দফতর বা উদ্যান পালন বিভাগের কাছে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য না থাকলেও তাদের অনুমান পূর্বস্থলী এলাকার কমবেশি প্রায় চল্লিশ ভাগ চাষযোগ্য জমি গত এক দশকের মধ্যে বদলে গিয়েছে ফলের বাগানে। তার বেশির ভাগই আম বাগান।

চাষিদের দাবি, মরসুমি ফল হলেও আমের মতো ব্যাপক চাহিদাযুক্ত ফল থেকে চাষিরা যতটা লাভের মুখ দেখেন তা অন্য কোনও ফসলে সম্ভব নয়। তাই পূর্বস্থলী, চুপ, কাষ্ঠশালির বিস্তীর্ণ এলাকায় বিঘের পর বিঘে চাষের ক্ষেতে সারি দিয়ে বসানো হয়েছে আম বা অনান্য ফলগাছের চারা। প্রথম বছর তিনেক জমির ফসল যেমন হত তেমনই হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত বাড়ছে উচ্চ ফলনশীল ওই সব চারার। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই গাছে ফল ধরছে। বছর চারেকের মাথায় রীতিমতো বাণ্যিজ্যিক ভাবে ফলন দিচ্ছে ওই সব গাছ।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, মালদহ-মুর্শিদাবাদের পর পূর্বস্থলীর মতো এতো বড় আম উৎপাদক এলাকা রাজ্যে আর নেই। যত দিন যাচ্ছে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। জেলার কৃষি আধিকারিকদের মতে, পূর্বস্থলীতে আমের শুধু ফলন বেশি তাই নয়। এখানকার আমের গুণগত মানও অনেক উঁচুতে। কম করে বারো থেকে চোদ্দ রকম আম হয়। কৃষি বৈচিত্রের কারণে আম, পেয়ারা, কুল, কলা- সব ধরনের ফলই প্রচুর পরিমাণে উৎপাদত হয়। যার নিট ফল দিনে দিনে পূর্বস্থলীর আবাদযোগ্য ক্ষেতের পরিমাণ কমছে। উল্টো দিকে বাড়ছে ফলের বাগান।

পূর্বস্থলী এলাকার অর্ধেকের বেশি মানুষ গরমের মরসুমে আম চাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যুক্ত থাকেন। অত্যন্ত ভাল মানের এবং নানা প্রজাতির আম পূর্বস্থলীতে অনেক দিন ধরে উৎপন্ন হয়ে আসছে। এলাকার বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানান, এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যগুলিতে যত আম সরবরাহ করা হয়, তার একটা বড় অংশই যায় পূর্বস্থলী থেকে। আসানসোল দুর্গাপুর রানিগঞ্জের বাজারে এখনকার বাগানগুলো থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কয়েক’শো লরিতে হেমায়েতপুর হয়ে কুইন্ট্যাল কুইন্ট্যাল আম সরবরাহ হয়। সেই আমই বিহার, ঝাড়খণ্ডে যায়।

বর্ধমানের সহ-কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘প্রকৃতির খাম খেয়ালিপনায় গতানুগতিক চাষে ক্রমশ ঝুঁকি বাড়ছে। উৎপাদিত ফসলের সঠিক সময়ে বাজার না পাওয়ায় চাষিরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। যে কারণে তাঁরা গতানুগতিক চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে বাগানের দিকে ঝুঁকছেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ফলের বাগান করলে মিলছে সরকারি সহায়তাও। সব মিলিয়ে এখন ধান বা সব্জি চাষ ছেড়ে বাগানমুখী পূর্বস্থলীর ফলেয়া, মেড়তলা, পলাশফুলি, বেলেরহল্ট, বিশ্বরম্ভা-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল।’’ পূর্বস্থলীর কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ফল চাষ যাতে ব্যহত না হয়, তার জন্য একটি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র এবং সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন পূর্বস্থলী সাংস্কৃতিক মঞ্চ। তাদের আক্ষেপ যদি এই আম কোনও ভাবে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে এলাকার হাল ফিরে যেত।

তবে যে হারে বিঘের পর বিঘে চাষের জমি ফলের বাগানে বদলে যাচ্ছে তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ওই এলাকার চাষিরা। এখনই চাহিদার তুলনায় ফলনের পরিমাণ বেড়ে যাওযায় আমের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। চাষিরা জানাচ্ছেন, পূর্বস্থলীর আমের বাজার প্রধানত আসানসোল, দুর্গাপুর এবং রানিগঞ্জ অঞ্চলে। সেই বাজারে যা চাহিদা তার থেকে আমের ফলন বেশি হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন আম চাষি থেকে বাগান মালিক সকলে। অত্যাধিক ফলনের জন্য চলতি মরসুমে সেই ক্ষতি পাহাড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্ষতির উদাহরণ দিতে গিয়ে পূর্বস্থলীর নতুনবাজারের আম চাষি জসিমুদ্দিন শেখ বলেন, “এ বার পাইকারি বাজারে আমের দর কেজি পিছু ৭ থেকে ৮ টাকার বেশি উঠলই না। অথচ গত বছরে এই আমই ১৪ থেকে ১৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।” এ বার চারদিকে এত আমের ফলন হয়েছে যে ওই দরে মহাজনের কাছে না বেচলে স্রেফ পড়ে পচে নষ্ট হবে আম। জসিমুদ্দিনের কথায়, ‘‘এ বার গরু ছাগলেও আম খাচ্ছে না। শুধু তাই নয় পাইকারী বাজারে আম বেচতে গিয়ে এ বার ফ্রিতে হচ্ছে ঝুড়ি দিতে হচ্ছে।’’

স্থানীয় বাসিন্দা এবং বহুদিনের বাগান মালিক শম্ভুনাথ দে বা দিলীপ কুমার মিত্ররা জানান, গত এক দশক ধরে এই রূপান্তরের পর্ব চলছে। কিন্তু সকলেই যদি উৎপাদক হয় তা হলে অধিক উৎপাদনের সমস্যা স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হবে।’’ পূর্বস্থলী বৈদিক পাড়ার আমচাষি মধুসূদন দাস ম্লান মুখে জানান, ‘‘আমের যা ফলন তাতে করে লাভ দূরের কথা চাষের খরচটুকুই উঠবে না। যদি এভাবে আমের বাগান এবং ফলন বাড়তেই থাকে তা হলে কিন্তু ফের বাগান কেটে গতানুগতিক চাষে ফেরা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE