Advertisement
০৪ মে ২০২৪

দশ কাঠা জমি বেচে মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন বাবা

চানাচুরের সঙ্গে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছিল স্বামী। অচেতন হয়ে পড়লে রাতের অন্ধকারে গা থেকে খুলে নিয়েছিল গয়নাগাটি। স্ত্রীর কাছে থাকা হাজার পাঁচেক টাকাও সরিয়েছিল। তারপরে অচৈতন্য স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ঢেলে পালায়।

সীমান্ত মৈত্র
বাগদা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:০৫
Share: Save:

চানাচুরের সঙ্গে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছিল স্বামী। অচেতন হয়ে পড়লে রাতের অন্ধকারে গা থেকে খুলে নিয়েছিল গয়নাগাটি। স্ত্রীর কাছে থাকা হাজার পাঁচেক টাকাও সরিয়েছিল। তারপরে অচৈতন্য স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ঢেলে পালায়।

দিনটা ছিল ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল। সে দিনের কথা মনে এখনও ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন বাগদার প্রত্যন্ত গ্রাম চরমণ্ডলের বাসিন্দা বছর বত্রিশের রিমা মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত)। মুখ তো বটেই, শরীরের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে, ঝলসে গিয়েছিল তাঁর। তবু হাল ছাড়েননি। স্বামীর অপরাধের শাস্তির আশায় এখন লড়াই চলছে তাঁর।

দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরলেও নিজেকে ঘরবন্দিই রাখেন রিমা। এক রকম বাধ্যই হয়েছেন বলা চলে। কারণ, তাঁকে দেখলে গ্রামের ছোটরা তো বটেই, বড়রাও আঁতকে ওঠেন। নানা মন্তব্য উড়ে আসে। টেলিফোনে জানালেন, দিন কয়েক আগে বর্ধমানে বোনের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। সেখানে লোকের বাড়িতে কাজ করে দু’পয়সা রোজগার শুরু হয়েছে।

সোমবার এক মামলায় অ্যাসিড আক্রান্তদের প্রতিবন্ধী আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই মতো নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে। অ্যাসিড বিক্রি বন্ধে আরও কড়া পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে রাজ্য সরকারকে দাঁড়াতে বলে এর আগেও নানা নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এমওয়াই ইকবাল এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পনের বেঞ্চ আরও বলেছে, অ্যাসিড আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শুধু যে কষ্ট শরীরের, তা নয়। পরবর্তী সময়ে সামাজিক ভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয় এই সব মেয়েদের। কাজের সুযোগও কমে আসে।

এ ক্ষেত্রে বাগদার ওই মহিলা সরকারি সাহায্য কতটা পেয়েছিলেন?

টেলিফোনে তিনি জানালেন, হাসপাতালের খরচ কিছুই মেলেনি। বনগাঁ হাসসপাতালে মাস ছ’য়েক চিকিৎসার পরে চিকিৎসকেরা তাঁকে পাঠিয়ে দেন আরজিকর হাসপাতালে। সেখানেও বেশ কিছু চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফেরেন রিমা। এখনও নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। ওষুধ খেতে হয়। তবে প্লাস্টিক সার্জারি করানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় চিকিৎসকদের সেই পরামর্শ মানতে পারেননি।

রিমার বৃদ্ধ বাবা বলেন, ‘‘মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে ইতিমধ্যেই দশ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছি। জানি না শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত শাস্তি পাবে কিনা।’’

চিকিৎসার খরচ না মিললেও সরকারি আইনজীবী বিনা খরচে আদালতে মামলা লড়ছেন বলে জানাল পরিবারটি। সুপ্রিম কোর্টের কড়া নির্দেশ বর্ধমান বা বাগদার গ্রামে রিমা বা তাঁর বাবার কাছে পৌঁছয়নি। সব শুনে রিমার প্রতিক্রিয়া, ‘‘এত দিন বহু কষ্টে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার যদি সত্যি পাশে দাঁড়ায়, তবে নিশ্চিন্ত হই।’’ কিন্তু কোথায় কার কাছে গেলে সাহায্যের আবেদন জানানো যাবে, তা এখনও জানেননি রিমারা।

রিমার কথায়, ‘‘আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে জীবনটা শেষ করে দিয়েছে ও (স্বামী)। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই অবস্থায় আমার নাকি বেশি দিন আয়ু নেই। কিন্তু ও কঠোর শাস্তি না পেলে আমার আত্মা মরেও শান্তি পাবে না।’’ রিমার আক্ষেপ, তাঁর কথা ভেবে ভেবেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মা। মারা গিয়েছেন বছর দেড়েক আগে।

কেন তাঁর উপরে রাগ ছিল স্বামীর?

রিমা জানালেন, বনগাঁ হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন তিনি। সেখানে চিকিৎসা করাতে এসেছিল মুর্শিদাবাদের রানিনগর থানা এলাকার এক যুবক। সেখান থেকে আলাপ, প্রেম ও বিয়ে। বিয়ের পরে মহিলা জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর আগেই বিয়ে হয়েছিল। তা নিয়ে গোলমাল শুরু। পরবর্তী সময়ে স্বামী কোনও কাজ করত না। মদ-জুয়ার ঠেকে টাকা উড়িয়ে বেড়াত। স্ত্রীর কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করত। না দিলেই চলত মারধর। বাড়িতেই বসত মদের আসর। রিমা প্রতিবাদ করলে শুরু হতো অশান্তি।

বিয়ের পরে মাত্র ছ’মাসের জন্য স্ত্রীকে নিয়ে বহরমপুরে বাসা ভাড়া করে গিয়েছিল স্বামী। তারপর রিমার বাপের বাড়ির পাশে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। ওই মহিলার কথায়, ‘‘আমারও অতীতে বিয়ে হয়েছিল। সেই পক্ষের দুই ছেলে। ঘটনার দিন আমার ছেলেদের আমার সঙ্গে না রেখে স্বামীর দাবি মেনে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেই রাতেই ও আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।’’

কী অবস্থায় আছে মামলাটি?

ঘটনার পরে ১৫ এপ্রিল তরুণীর বাবা বাগদা থানায় জামাইয়ের বিরুদ্ধে মেয়েকে অ্যাসিড মেরে খুনের চেষ্টার লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশ বধূ নির্যাতন ও খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করে। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও ধরা যায়নি রিমার স্বামীকে। ওই ব্যক্তিকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে পুলিশ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শেষমেশ, কয়েক মাস বাদে ধরা পড়ে অভিযুক্ত।

কয়েক মাস জেলে থাকার পরে সে জামিনও পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মামলাটি শুনানি শুরু হয়েছে। বনগাঁ মহকুমা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক ২-এর এজলাসে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে রিমার বাবা ইতিমধ্যেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। রিমারও গোপন জবানবন্দি নিয়েছেন বিচারক।

কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হতে এত সময় লাগছে কেন?

বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য ভারপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবী সমীর দাস জানিয়েছেন, অভিযুক্ত দীর্ঘদিন ফেরার থাকায় শুনানি শুরু হতে দেরি হয়েছে। এখন অবশ্য সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। মাস ছ’য়েকের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে বলে আমাদের আশা।’’

কেন অভিযুক্তকে ধরতে এত সময় লাগল? সমীরবাবু জানান, অভিযুক্তের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগর থানা এলাকায়। সে কারণে বাগদা পুলিশের পক্ষে তল্লাশি করতে কিছুটা বেশি সময় লেগেছে। রানিনগর থানার সঙ্গে যৌথ ভাবেও তল্লাশি চলেছিল। কিন্তু সে বার অভিযুক্তকে ধরা যায়নি।’’ সরকারি সাহায্য পেতে গেলে কী করতে হবে, তা নিয়ে রিমাকে তিনি সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন সমীরবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE