পুরুলিয়ায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্র। ছবি: সুজিত মাহাতো।
হিংসা নেই, রক্তপাত নেই বহুকাল। মাওবাদী কার্যকলাপ নেই বলে। কিন্তু বারুদের গন্ধহীন সেই জঙ্গলমহলের দু’প্রান্তের দুই এলাকায় হঠাৎই এমন অস্ত্রশস্ত্রের হদিস, যা সাধারণত মাওবাদীরাই ব্যবহার করে।
হাতিয়ার যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেই পুরুলিয়ার কোটশিলা ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি দু’টোই ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা। পশ্চিমবঙ্গের পড়শি ওই রাজ্যে মাওবাদী হিংসার এখনও বিরাম নেই। কোটশিলায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে আছে রকেট ও রকেট লঞ্চার। রাজ্যে এমন অস্ত্র উদ্ধার হওয়ার ঘটনা এ-ই প্রথম বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
শুক্রবার রাতে কোটশিলার খটঙ্গা গ্রাম থেকে দু’কিলোমিটার দূরে একটি শ্মশানের পাশের জমি খুঁড়ে ওই রকেট ও রকেট লঞ্চারের সঙ্গে পাওয়া যায় একে ফর্টি সেভেনের মতো দেখতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র। সঙ্গে খালি ম্যাগাজিন। প্লাস্টিক দিয়ে সযত্নে মোড়া ছিল। মাওবাদীদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখার সঙ্গে এর মিল পাওয়া যাচ্ছে বলে গোয়োন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন।
আবার কোটশিলার প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দক্ষিণে, বেলপাহাড়ির শাঁখাভাঙা গ্রাম থেকে শনিবার ভোরে দু’টি শক্তিশালী ল্যান্ডমাইন উদ্ধার করা হয়। শাঁখাভাঙা লাগোয়া ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ঘাঘরা গ্রামে পাওয়া যায় আরও দু’টি। লাল মাটির রাস্তায় পোঁতা চারটি মাইনই উদ্ধার করেন সিআরপি-র বিশেষ বাহিনী কোবরা-র জওয়ানেরা।
একটা সময়ে খটঙ্গা ও শাঁখাভাঙা দু’টি তল্লাটেই মাওবাদীদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা আইবি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘দু’টো জায়গায় যে সব অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো সাধারণত মাওবাদীরাই ব্যবহার করে। তবে কী ভাবে ও কী কারণে সেগুলো ওখানে রাখা হয়েছিল, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’’
কোটশিলায় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র এবং রকেট ও রকেট লঞ্চারের সন্ধান মিলেছে সম্প্রতি ধরা পড়া দুই অস্ত্র কারবারির কাছ থেকে। তাদের মধ্যে রথু প্রামাণিক কোটশিলারই বাসিন্দা। আর জামালউদ্দিন নামে অন্য জনের বাড়িও কোটশিলার খটঙ্গায়। তবে বছর খানেক যাবৎ সে বোকারোর মোহনডিহি গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে থাকছিল। গত ২৪ জুলাই একটি কার্বাইন ও বুলেট-সহ পেশায় সেলাইয়ের দোকানি জামালউদ্দিনকে গ্রেফতার করে। রথু পেশায় কৃষক। জামালউদ্দিনের বক্তব্য ছিল, ওই আগ্নেয়াস্ত্র সে রথুকে দিতে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল।
শনিবার পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, ‘‘রথু ও জামালউদ্দিনকে জেরা করেই রকেট লঞ্চার, রকেট ও আধুনিক একটি রাইফেল উদ্ধার হয়েছে।”
১৯৯৫-এর ১৭ ডিসেম্বর রাতে এই খটঙ্গা ও তার আশপাশের কয়েকটি গ্রামেই অস্ত্রবর্ষণ হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল প্রচুর কালাশনিকভ রাইফেল ও রকেট লঞ্চার। বরাবরই গোয়েন্দারা বলে এসেছেন, সব অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। এ দিন খটঙ্গায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্র তারই অংশ বলে পুলিশের একাংশের মত। এসপি জানান, পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে।
তবে আইবি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণে আসল একে ফর্টি সেভেন রাইফেল ফেলা হয়। খটঙ্গায় উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রটি দেশি বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। বিহারের মুঙ্গেরে কালাশনিকভ রাইফেলের আদলে অস্ত্র তৈরি হয়।’’
তবে পুলিশ চিন্তিত রকেট লঞ্চার নিয়ে। মাওবাদীরা যে নিজেরা রকেট লঞ্চার তৈরি করছে, সেটা কলকাতায় ধরা পড়া তাদের টেকনিক্যাল কমিটির মাথা সাদানালা রামকৃষ্ণ ও দীপক কুমারের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল। ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীরা ওই অস্ত্র ব্যবহারও করেছে। কিন্তু এই রাজ্যে লালগড় আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়েও রকেটের ব্যবহার হয়নি। এত দিন উদ্ধারও হয়নি।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, খটঙ্গায় মেলা রাইফেল ও রকেট-সহ লঞ্চার পুরনো হলেও শাঁখাভাঙা গ্রামের মাটি খুঁড়ে পাওয়া ল্যান্ডমাইন সদ্য পোঁতা হয়েছিল। কোবরা বাহিনী সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে। সিআরপি সূত্রের দাবি, সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড লাগোয়া ওই এলাকায় মাওবাদী আনাগোনার খবর ছিল। সিআরপির এক আধিকারিক বলেন, “গত তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম এত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মাইন পাওয়া গেল। বোঝাই যাচ্ছে, সেগুলি নতুন। বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটানোর জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছিল।”
সিআরপি-র দাবি, মাইনগুলোর সার্কিটের গঠনসজ্জা ছিল আধুনিক। তবে তার বা ডিটোনেটর লাগানো ছিল না। পরে সুযোগ বুঝে সে সব জোড়া হত বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy