মুখ্যমন্ত্রী অথবা বিভাগীয় মন্ত্রীকে দিয়ে উড়ালপুলের ফিতে কেটেই যেন খালাস সরকারি কর্তারা। বাধ্যতামূলক পর্যবেক্ষণ বা জরিপ হচ্ছে সামান্যই। এ ছাড়াও, মন্ত্রীর কথাই সার। উড়ালপুল রক্ষণাবেক্ষণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা (হেল্থ অ়়ডিট) এখনও বিশ বাঁও জলে। পরিস্থিতির বদল না হলে ভবিষ্যতে আরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা।
ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেসের (আইআরসি) নিয়মাবলীর ‘ব্রিজ’ পরিচ্ছদে বাৎসরিক সমীক্ষার কথা আছে। কেএমডিএ-র প্রাক্তন ডিজি সুবোধ ভট্টাচার্য এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘বছরে একবার, সাধারণত বর্ষার পর সেপ্টেম্বর মাসে এই সমীক্ষা করার কথা।’’ কেএমডিএ-র অন্দরের খবর, এটা আদৌ হয় না।
আইআরসি-র বিধান মেনে আগেও যে নিয়মিত সেতু ও উড়ালপুল সমীক্ষা হতো, তা নয়। খোদ সুবোধবাবুর স্বীকোরোক্তি, ‘‘আশির দশকের গোড়ায় বিশ্বব্যাঙ্কের টাকায় ইএম বাইপাস সম্প্রসারণের কাজ করতে গিয়ে দেখি বিভিন্ন ছোট সেতু বা কালভার্টের নীচগুলোয় প্রচুর ক্ষত। লোহায় জং ধরে গিয়েছে। তখন এককালীন সেগুলি ঠিকঠাক করে দেওয়া হয়েছিল।’’
প্রতিটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত হয়। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট হয় প্রকাশিত হয় না। অথবা, সুপারিশ রূপায়িত হয় না। ২০১৩-র ৩ মার্চ পোস্তার উড়ালপুল দুর্ঘটনার পর নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছিলেন, এ বার থেকে সেতুগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা (হেল্থ অ়়ডিট) করা হবে। এই পরীক্ষাগুলিও যথাযথ হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ফলে, আমজনতার একাংশের মনে প্রশ্ন উঠেছে, আবারও কি এরকম হবে? নির্মীয়মাণ নানা উড়ালপুলে কি নেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত সতর্কতা? ব্যবহৃত সরঞ্জামের ব্যাপারেই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
সমস্যাগুলো কোথায়? সাড়ে তিন দশক কেএমডিএ-র শীর্ষপদে কাজ করেছেন দেবব্রত বিশ্বাস। হেল্থ অ়়ডিট যথাযথ হচ্ছে না স্বীকার করে বলেন, ‘‘এটা ঠিকঠাক করা হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেকটা কমতে বাধ্য। আমজনতার আতঙ্কও কমবে!’’ আপনি তো বেশ কিছুকাল উচ্চপদে আসীন ছিলেন, কেন করাননি? ‘‘সব কিছু তো আমার এক্তিয়ারে নয়! তবে, প্রকল্পের নিরাপত্তার দিকে আমি সব রকম নজর রাখতাম। সমঝোতার কোনও রাস্তা রাখতাম না।’’ আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যদি নিরাপত্তাবিধিকে গুরুত্ব না দিই, বিপদের আশঙ্কা তো বাড়বেই!’’
হেল্থ অ়়ডিটে খামতির কথা স্বীকার করেছেন কেএমডিএ-র প্রাক্তন সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার অমলেন্দু ভট্টাচার্যও। এই সঙ্গে ওটাও স্বীকার করেছেন, এ রকম নিরন্তর নজরদারি না থাকলে ভবিষ্যতেও উড়ালপুল দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কর্মরত অবস্থায় কেন তাহলে আপনি নিজে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হননি? অমলেন্দুবাবুর বক্তব্য, ‘‘সাড়ে তিন দশক এই সংস্থায় কাজ করেছি। গোটা প্রশাসনে ক্রমে একটা ঢিলেঢালা ভাব এসে গিয়েছে। আমি তো প্রশাসনের একটা ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।’’ নিয়মিত হেল্থ অ়়ডিট না হওয়ার দায়টা কার? অমলেন্দুবাবুর বক্তব্য, ‘‘দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট না করলে কাউকে আলাদাভাবে দোষ দেওয়া যাবে না।’’
এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে সমস্যার বীজ। কেএমডিএ-র প্রাক্তন অতিরিক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার অশোক বসুর মন্তব্য, ‘‘কেবল হেল্থ অ়়ডিট করলে হবে না, প্রতিটি স্তরে দায়বদ্ধতা আনতে হবে। অদক্ষ বা কম দক্ষ কর্মীকে গুরুদায়িত্ব দিলে সমস্যা বাড়বে!’’
পোস্তাকাণ্ড থেকে নির্মীয়মাণ উড়ালপুলগুলির তদারককারীরা কি শিক্ষা নিচ্ছে? জিঞ্জিরাপোল-বাটানগর প্রকল্পের ঠিকাদার সংস্থার বর্তমান পরামর্শদাতা কেএমডিএ-র প্রাক্তন ডিজি দেবদাস ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘চার দশকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি, পোষাকি ‘হেল্থ অ়়ডিট’-এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিরন্তর ও নিয়মিত নজর। যেমন, নির্মীয়মাণ বা নিয়মিত উড়ালপুলের কোনও জায়গায় জল জমে ‘বিয়ারিংয়ের’ ক্ষয় হচ্ছে। সেটা সময়মত না মেরামত করলে ক্ষতি তো হবেই!’’
সরঞ্জামের মান প্রসঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের দাবি, ‘‘সাধারণত নামী কোনও সংস্থা খারাপ মানের জিনিস ব্যবহার করে না। তবে, এদিকেও নিরন্তর নজরদারি দরকার।’’
আরও পড়ুন...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy