Advertisement
E-Paper

শিক্ষাবন্ধুর হাতেই সংবর্ধনা নিয়ে মন্ত্রী বললেন, ছাড় নয়

চব্বিশ ঘণ্টা আগে তাঁরা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। নিরাপত্তা আধিকারিককে মারধর, মহিলা শিক্ষককে নিগ্রহ, উপাচার্যের ঘরে গ্রিল ভেঙে ঢোকার চেষ্টা বাদ রাখেননি কিছুই। বুধবার সেই ‘শিক্ষাবন্ধু’ ওরফে তৃণমূলি শিক্ষাকর্মীরাই লাল গোলাপ দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন শিক্ষামন্ত্রীকে। উপাচার্যের ঘরে তাঁদের নিয়েই বৈঠক করলেন শিক্ষামন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৬
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই শিক্ষামন্ত্রীর হাতে গোলাপের তোড়া। বুধবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই শিক্ষামন্ত্রীর হাতে গোলাপের তোড়া। বুধবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

চব্বিশ ঘণ্টা আগে তাঁরা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। নিরাপত্তা আধিকারিককে মারধর, মহিলা শিক্ষককে নিগ্রহ, উপাচার্যের ঘরে গ্রিল ভেঙে ঢোকার চেষ্টা বাদ রাখেননি কিছুই। বুধবার সেই ‘শিক্ষাবন্ধু’ ওরফে তৃণমূলি শিক্ষাকর্মীরাই লাল গোলাপ দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন শিক্ষামন্ত্রীকে। উপাচার্যের ঘরে তাঁদের নিয়েই বৈঠক করলেন শিক্ষামন্ত্রী। যদিও বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের বললেন, “যাঁদের নামে এফআইআর হয়েছে, যে মহিলাকে মারধর করতে টিভিতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে বলেছি।”

কিন্তু ঘটনা হল, মঙ্গলবারের ঘটনার পর প্রাথমিক ভাবে কোনও এফআইআর-ই হয়নি। ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে শুধু একটি ডায়েরি করেছিল পুলিশ। এ দিন পার্থবাবুর সঙ্গে বৈঠকের পরে এফআইআর দায়ের করা হয় সাত জনের নামে। তার মধ্যে শিক্ষাবন্ধু সেলের কল্যাণী ইউনিটের নেতা অঞ্জন দত্তের নাম আছে। তবে মারমুখী মহিলার নাম নেই। টিভির ছবি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এখনও তাঁকে শনাক্তই করতে পারেনি!

কল্যাণীতে শিক্ষাবন্ধুদের ‘সহিংস’ আন্দোলনের ছবি মঙ্গলবার টিভিতেই দেখেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার পরই তিনি আন্দোলনকারীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, মারধরের ঘটনা দল সমর্থন করে না। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাসও তখনই দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।

বুধবার দুপুর একটা নাগাদ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে থামে পার্থবাবুর গাড়ি। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন বেসরকারি বিএড কলেজের হাজারখানেক পড়ুয়া। তাঁরা মন্ত্রীকে ঘিরে ধরে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী ও শিক্ষাবন্ধু সমিতির সদস্যরা ছুটে আসেন। কার্যত শিক্ষাবন্ধু সমিতির সদস্যরাই বিক্ষোভ থেকে মন্ত্রীকে বের করে নিয়ে যান উপাচার্যের ঘরে। মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা দেন তাঁরা। ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন উপাচার্য রতনলাল হাংলু-ও। তাঁর ঘরেই দুপুর দেড়টা থেকে দফায় দফায় চলে আলোচনা। আলোচনায় যোগ দেন আগের দিনের বিক্ষোভকারীরাও।

এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, যারা তাণ্ডব চালাল, তাদের হাত থেকেই তো মন্ত্রী সংবর্ধনা নিলেন! তাদের সঙ্গেই আলোচনায় বসলেন! এর পর পুলিশ তাদের ধরবে কি? পার্থবাবুর বক্তব্য, “তাণ্ডবকারীরা আমার সঙ্গে ছিল কি না আমি জানি না। কারণ সকলকে আমি চিনি না। কে সংবর্ধনা দিচ্ছে, কার হাত থেকে সংবর্ধনা নিচ্ছি তা কি সব সময় খেয়াল করা সম্ভব?” তাঁর দাবি, দোষীরা শাস্তি পাবেই। কোনও রঙ বা পতাকা দেখে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পার্থবাবুর সঙ্গে আলোচনার পরে কল্যাণীর এসডিপিও রানা মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মন্ত্রী বলেছেন। ওই ঘটনার সঙ্গে কোনও ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা-ও তিনি দেখতে বলেছেন।”

তবে শিক্ষামন্ত্রীর চাপে এ দিন খানিকটা পিছু হঠে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি থেকে সরে এসেছে শিক্ষাবন্ধুদের সংগঠন। এ দিন সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির সভাপতি দেবব্রত সরকার বলেন, “আমরা উপাচার্যের যে পদত্যাগ দাবি করেছিলাম, তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। গত কালের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি।” বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি ইন-চার্জ প্রতাপ সাঁতরার নিগ্রহকারী মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ অস্বীকার করে তাঁর দাবি, “সিপিএম, বিজেপি ষড়যন্ত্র করে (ওই মহিলাকে) আমাদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।” প্রতাপবাবুর সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। পাওয়া যায়নি নিগ্রহকারিণীকেও।

কিন্তু উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে যে বিক্ষোভ চলছিল, তার কী সমাধান হল? শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কর্তৃপক্ষ এবং আন্দোলনকারী, দু’পক্ষই আপাতত নমনীয় হয়ে আপস-রফায় এসেছেন। উপাচার্য সকালেই সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “রাজ্য সরকার চাইলে আমি পদত্যাগ করব।” মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁর বক্তব্য, “এ দিনের আলোচনায় আমিও খুশি। পদত্যাগ করার প্রশ্নই আসছে না।” তিনি জানিয়েছেন, যে বিষয়গুলি নিয়ে সংঘাত দেখা দিয়েছিল, তার কয়েকটি নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বহিরাগতদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢোকার জন্য উপাচার্য যে কর্মীদের শো-কজ করেছিলেন, সেই বিষয়টা দেখার জন্য এ দিন কমিটি তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী আবাসন দখলে রাখা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতেও আর একটি কমিটি হয়েছে। ছাত্র প্রতিনিধিরাও এ দিনের আলোচনায় খুশি। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ মণ্ডল বলেন, “আমাদের দাবি মেনে নিয়ে ভর্তি ফি কমানো হয়েছে। ক্যান্টিনের ব্যবস্থা ও অসম্পূর্ণ ফল প্রকাশেরও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।” খুশি বিএড কলেজের মালিক ও পড়ুয়ারাও। এ দিন মন্ত্রী আসার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মোটরবাইক মিছিল করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদেরসমর্থকরা। রেজিস্ট্রেশন না-পাওয়া বিএড কলেজের পড়ুয়ারাও সকাল থেকেই জমায়েত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

পার্থবাবু এসে এ দিন উপাচার্যের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক পার্থসারথি দে, রেজিস্ট্রার প্রসেনজিৎ দেব-সহ অন্য আধিকারিক ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র প্রতিনিধি, বিএড কলেজগুলোর তিন মালিক, দু’জন পড়ুয়া এবং সব শেষে শিক্ষাবন্ধু সমিতির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আলোচনা শেষ হয়। উপাচার্যের ঘর থেকে বেরিয়ে পার্থবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চান না, শিক্ষাঙ্গনে ঝুটঝামেলা, গণ্ডগোল হোক। সেটা আমরা বরদাস্ত করব না।”

মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রী, উভয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পার্থবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই এ দিন তিনি কল্যাণী এসে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপের কথা বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন। এ দিন রাজ্যপালও এক অনুষ্ঠানে বলেন, “কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা খুব দুর্ভাগ্যজনক।” দুর্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুও বলেন, “শিক্ষাঙ্গনে এমন ঘটনা অনভিপ্রেত। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। পুরোটা হয়েছে বলা যাবে না।” তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, সংবাদমাধ্যমের সামনে ফের মুখ খোলায় এ দিন তৃণমূল ভবনে এসে দলনেত্রী সুগতবাবুকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন।

siksha bandhu samity kalyani university partha chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy