ঘনত্ব বাড়ছে বনের। —নিজস্ব চিত্র।
ঝাড়গ্রামের বনাঞ্চলে ‘জঙ্গলের স্বাস্থ্য’ বাড়ছে!
জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই সবুজ ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে। উন্নয়নের প্রয়োজনে গত কয়েক বছরে অজস্র শাল ও অন্যান্য গাছ কাটা পড়েছে। এ সব সত্ত্বেও ঝাড়গ্রামের বনভূমিতে কিন্তু শাল গাছের গড় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে বলে দাবি বন দফতরের। এই অসাধ্য সাধনের জন্য অবশ্য জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদেরই সিংহভাগ কৃতিত্ব দিচ্ছেন বনকর্মীরা। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ঝাড়গ্রামে জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ার কারণেই রেসিডেন্ট হাতিরাও এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে।
ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের বিভাগীয় এক পর্যবেক্ষণে জানা গিয়েছে, বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, বেলপাহাড়ি, শিলদা, জামবনি, গিধনি, পড়িহাটি, ঝাড়গ্রাম, লোধাশুলি, মানিকপাড়া, গোপীবল্লভপুর ও হাতিবাড়িয়া-এই ১২টি রেঞ্জ বা বনাঞ্চল এলাকায় শাল গাছের জন্য বরাদ্দ মোট বনভূমির আয়তন ৪৩,১৫০ হেক্টর। সত্তর-আশির দশকে চোরা কারবারিদের দাপটে নির্বিচারে জঙ্গল ধ্বংসের অভিযোগ ওঠায় জঙ্গল রক্ষার তাগিদে নব্বইয়ের দশকে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে বন সুরক্ষা কমিটি (এফপিসি) গঠন করা হয়। ২০০৯-১০ সালে মাওবাদী সন্ত্রাস পর্বে জঙ্গলমহলে রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ-আন্দোলনের জন্য ব্যাপক হারে গাছ কাটা পড়ে। অভিযোগ, ওই সময় বেলপাহাড়ি ও বাঁশপাহাড়ির বনাঞ্চল থেকে জঙ্গল মাফিয়ারাও যথেষ্ট গাছ কেটে পাচার করে দেয়। ওই পর্বে বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম, লোধাশুলি, মানিকপাড়ার মতো বনাঞ্চল এলাকায় প্রতি হেক্টর বনভূমিতে শাল গাছের গড় সংখ্যাটা ছিল, ৫০ থেকে ১০০-র মধ্যে। বন দফতরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, এখন ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের ১২ টি রেঞ্জ এলাকায় প্রতি হেক্টর বনভূমিতে শালগাছের গড় সংখ্যাটা ২০০ থেকে ৩০০-র কাছাকাছি। অর্থাত্ ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের আওতাধীন ঝাড়গ্রাম মহকুমার মাত্র চারটি ব্লকে মোট শাল গাছের সংখ্যাটা এখন ১ কোটি ২৯ লক্ষ ৪৫ হাজারের আশেপাশে। পরিসংখ্যানে উজ্জীবিত হয়ে সম্প্রতি আরও ৭০০ হেক্টর বনভূমিতে শাল গাছের চারা রোপণ করেছে বন দফতর। এর ফলে আগামী দশ বছরের মধ্যে আরও দেড় লক্ষ শাল গাছ মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন বন কর্মীরা।
কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হল? ঝাড়গ্রামের ডিএফও ধর্মদেও রাই বলেন, “ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের ১২ টি রেঞ্জ এলাকায় মোট ৪৭৪টি বন সুরক্ষা কমিটি রয়েছে। মোট সদস্য সংখ্যা ৪০ হাজার ৭০৩ জন। এই কমিটি গুলির সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবুজের পরিধি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।” ডিএফও জানান, নিয়মিত বন সুরক্ষা কমিটি গুলির সঙ্গে তিনি নিজে এবং দফতরের অন্যান্য আধিকরিক ও বনকর্মীরা বৈঠক করেন। সারা বছর কমিটিগুলির সঙ্গে কার্যত পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এর সুফলও মিলছে। কমিটিগুলিকে বনজ সম্পদ বিক্রির ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হচ্ছে। সেই টাকা প্রত্যেক সদস্য সমান ভাগে পাচ্ছেন। মানিকপাড়ার রেঞ্জ অফিসার বিজনকুমার নাথ বলেন, “গ্রামের সবাইকে গুরুত্ব দিয়ে কমিটিতে রাখা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন বুঝছেন, জঙ্গল বাঁচলে, তাঁরাও বাঁচার রসদ পাবেন।”
নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামবাসীদের নিয়ে এক বন সুরক্ষা কমিটি গড়ে তোলা হয়। উত্তরবঙ্গের মতো দক্ষিণবঙ্গের এই সব জঙ্গল কিন্তু রিজার্ভ বা সংরক্ষিত নয়। এখানকার জঙ্গলগুলি ‘প্রোটেক্টেড’ এবং উত্পাদনমুখী। তাই এখানে শাল জঙ্গলকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। জঙ্গলমহলের বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা তাই জঙ্গলে শুকনো ডালপাতা, কাঁচা শালপাতা, কেন্দুপাতা, ভেষজ উদ্ভিদের মতো বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে পারেন। আবার সরকারি ভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জঙ্গলের বিভিন্ন এলাকায় পর্যায়ক্রমে শাল গাছ কাটা হয়। এমন কৌশলে গাছ কাটা হয় যে, বর্ষার জল পেয়ে কাটা জায়গা থেকে ফের নতুন শাল গাছ জন্মে যায়। এটিকে বলা হয়, ফরেস্ট ফেলিং। গাছ কেটে সেগুলিকে নীলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বনজ সম্পদ বিক্রি করে প্রতি বছর গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা আয় হয় বন দফতরের। সেই টাকার ২৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার এফপিসি পায়। গোপীবল্লভপুর রেঞ্জের খাঁদিশোল এফপিসিকে গত বছর লভ্যাংশ বাবদ প্রায় ৩ লাখ ৯ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ১৭ জন সদস্যের প্রত্যেকে ১৮ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। আবার মানিকপাড়া রেঞ্জের আমডিহা এফপিসির ১৩৬ সদস্যের প্রত্যেকে গড়ে ৩ হাজার টাকা করে পেয়েছেন।
ইন্দ্রজিত্ মাহাতো, মানিক হাঁসদা, কৃষ্ণা মাহাতোর মতো এফপিসি সদস্যের বক্তব্য, “জঙ্গল রক্ষা করে সংসারে বাড়তি টাকা আসছে। ফরেস্টবাবুরা বুঝিয়েছেন, জঙ্গলই আমাদের সম্পদ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy