Advertisement
E-Paper

দলের সুখের দিনেও মুখ লুকোচ্ছেন ওই চার জন

আশা ছিল। (এবং অবশ্যম্ভাবী) ‘ভালবাসা’ও ছিল। তাই তো বিধাননগরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ঘাসফুল ফোটাতে নেমেছিলেন মহম্মদ নাজিরুদ্দিন। কিন্তু শনিবার ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখলেন, দলের দুই সাংসদ-খচিত পুরনো এক বাংলা ছবির গান যেন বেজে চলেছে আকাশে-বাতাসে— ‘‘ফুল কেন লাল হয়! সে কি বলা যায়?’’

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৬

আশা ছিল। (এবং অবশ্যম্ভাবী) ‘ভালবাসা’ও ছিল।

তাই তো বিধাননগরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ঘাসফুল ফোটাতে নেমেছিলেন মহম্মদ নাজিরুদ্দিন। কিন্তু শনিবার ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখলেন, দলের দুই সাংসদ-খচিত পুরনো এক বাংলা ছবির গান যেন বেজে চলেছে আকাশে-বাতাসে— ‘‘ফুল কেন লাল হয়! সে কি বলা যায়?’’

যে ছেলেগুলো তাঁর হয়ে ভোটে খাটল, তারাই এখন হইহই করে লাল আবির মাখছে! আর তিনি, নাজিরুদ্দিন ওরফে চাঁদু তৃণমূলের টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। দেখছেন তাপস-শতাব্দীর গন্ধমাখা ‘ফুল’ লাল হয়ে গিয়েছে! বাহিনীর আনাচে কানাচে মিরজাফর, আর তিনি টেরই পাননি!

রোববারের ঝিমঝিম দুপুর। কৈখালির ‘রায় নিলয়’-এর বৈঠকখানা। চেয়ারে গা এলিয়ে অমিত রায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যারিস্টার নায়কের নামে যাঁর নাম, ভোটটা তাঁকেই এক রকম ‘শেষের’ কবিতা দেখিয়ে ছাড়ল। না হলে যে জিম্বুদা, মানে তাপস চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে লাল জার্সি ছেড়ে সবুজ পরলেন, সেই দাদা সাড়ে সাত হাজার মার্জিন রেখে ফাটিয়ে জিতলেন। আর তিনি কি না হেরে ভূত! আটঘরায় ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী অমিত ছিলেন সাবেক রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান পারিষদ। দলবল নিয়ে গণনাকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। দেখলেন, ধক করে নিভে গেল বুক ভরা আশা!

এই কি চেয়েছিলেন!

‘দিদি’ চেয়েছিলেন বিধাননগরে ৪১ ঘাসফুলের মালা। সে আশ মেটেনি। মালা গাঁথা হতে দেখা গিয়েছে, চারটে ফুল কম। ভোটার খেদিয়ে, সাংবাদিক পিটিয়ে, গুন্ডা নামিয়ে সারা পাড়ার পিলে চমকে ভোট করানোর অভিযোগের কালি যতই থাকুক, শনিবার বিধাননগরের কালো পিচরাস্তা আবিরে আবিরে সবুজ হয়েছিল! কিন্তু ওই চার ফুলের দীর্ঘশ্বাসে চার পাড়ার বাতাস এখনও ভারী।

১৩ নম্বর ওয়ার্ডে নাজিরুদ্দিন, ১২-য় অমিত ছাড়াও ১৪ নম্বরে হেরেছেন রেবেকা সুলতানা। আর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে মহম্মদ খুরশিদ। তৃণমূলের এই চার পরাজিত প্রার্থীর দশা বড়ই করুণ। দলের সুখের দিনে হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।

কেউ ঘরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ বা অন্য কাজে যথাসম্ভব নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টায়। অমিত যেমন বললেন, ‘‘আমার আবার বাড়িতে পুজো হয়। এ বার সে-দিকটা দেখতে হবে।’’ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের খুরশিদকে এ দিন সকালে বহু কষ্টে ফোনে ধরতেই সটান জানিয়ে দিলেন, ‘‘আমি তো প্রাথমিক স্কুলের মাস্টার! আজ টেট পরীক্ষা। এখন কথা বলা যাবে না।’’ অগত্যা কথাটা পাড়া গেল তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে। শুনে দু-এক জন বলেই ফেললেন, এক মন্ত্রীর ‘পাপ’ বয়ে বেড়াতে হল বলেই নাকি কপাল পুড়ল খুরশিদের। খোঁচাটা যাঁর দিকে, তিনি রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। তাঁরই আপ্ত সহায়ক দেবরাজ চক্রবর্তী টিকিট না পেয়ে কংগ্রেসে গেলেন। পাল্টা খুরশিদের হয়ে অনেক মন্ত্রী-সান্ত্রি নামলেন বটে। কিন্তু দলের ছেলেদের অনেকেই নাকি হাত গুটিয়ে বসে মজা স্রেফ দেখলেন।

ফলে জেলে গিয়েও বাজি মেরে দিলেন ‘কচি ছেলে’ দেবরাজ। ফিচেল হাসি হেসে কৈখালি এলাকার এক তৃণমূলকর্মী বলছিলেন, ‘‘আমাদের ওয়ার্ডে সুমোয় চেপে আসা জেলার কর্মীরা কেউ ঢুকতেই পারেনি! উল্টে দলীয় অফিসে বসেই ঠ্যাঙানি খেলেন দক্ষিণ দমদমের কাউন্সিলর।’’ সন্ধেয় অনেক পীড়াপীড়ির পরে খুরশিদ বললেন, ‘‘কী করব! দেবরাজ কত রকমের টোপ দিয়ে কর্মীদের ভাঙিয়ে নিয়ে গেল!’’

খুরশিদের নামে তবু ‘মন্ত্রীর পাপ’-এর রসিকতা জুড়েছে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের গীতা সর্দারের কাছে হেরে যাওয়া রেবেকা সুলতানার কথা উঠতে তো অনেকে বললেন, ‘‘বেচারির হাল হয়েছিল বাপে খেদানো, মায়ে খেদানো সন্তানের মতো।’’ ছিলেন সল্টলেকের বৈশাখী এলাকার কাউন্সিলর। তাঁকে এ বার ১৪ নম্বরে হাতিয়াড়া-ঘুণিতে ঠেলে দিয়েছিল তৃণমূল। রেবেকা বুঝেছিলেন, এ ওয়ার্ড বড় কঠিন ঠাঁই।

বাম আমলেও ১৪ নম্বরে কংগ্রেসকে হারানো যেত না। সেখানে ভোটের দিন নাকি পুলিশ-র‌্যাফ শাসক দলের ক্যাম্পকেই বারবার ধমকে যাচ্ছিল। রেবেকার হয়ে ভোটে খাটা এক কর্মীর কথায়, ‘‘অচেনা এলাকা। ভোটে ল়ড়ার জন্য বাইরে থেকে সাপোর্ট দেওয়া তো দূর, প্রার্থীকে অথৈ জলে ফেলে নেতারা ফিরেও তাকাননি।’’

এ দিন বৈশাখীর ফ্ল্যাটে বেল বাজানোর পর দরজা খুলতেই বোঝা গেল, গত ২৪ ঘণ্টায় রেবেকার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। চোখমুখ ফোলা! মানে সম্ভবত কান্নাকাটি করেছেন বিস্তর। বললেন, ‘‘যা বলার সরাসরি দিদিকেই বলব।’’

সিপিএম-ত্যাগী অমিতের অনুগামীরাও ‘অ্যাওয়ে ম্যাচ’-এর চাপের কথা বলছেন— ‘‘দাদা চিরকাল ৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাজনীতি করেছেন। তাঁকে লড়তে পাঠাল কি না ১২ নম্বরে!’’ কিন্তু বাইরের মাঠেও যে ম্যাচ জেতা যায়, সেটা তো দেখিয়ে দিয়েছেন স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়। সল্টলেকের কাউন্সিলর এ বার জিতেছেন সাবেক রাজারহাট-গোপালপুর এলাকা (অধুনা ৫ নম্বর ওয়ার্ড) থেকে। তা হলে আপনি হারলেন কেন?

বোঝাই যাচ্ছিল জোর করে মুখে হাসিটা টেনে আনছেন। অমিত এ বার বলেই ফেললেন, ‘‘দলের কেউ কেউ চায়নি আমি জিতি।’’ আর তাঁর দলে খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল, তা শুনলে চমকিত হতে হয়। কর্মীদের কাছে বকলমে নাকি নির্দেশ ছিল, ‘তাপসকে জিতিয়ে আনতে হবে, কিন্তু পুরনো ডালপালা ছেঁটে।’ সোজা অঙ্ক— তাপসের ‘ডালপালা’ অমিত তাই ঘরের মাঠে ‘ক্লাব হাউসের’ টিকিট পাননি, তাঁর হয়ে ঘাসফুলের ‘স্পেশ্যাল টিম’ও নামেনি। উল্টে ছিল গোঁজের কাঁটা।

এ কাঁটা কেমন কাঁটা?

অমিতের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে এ বার অনিল পোদ্দার নামে এক তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ দাঁড়িয়েছিলেন নির্দল হয়ে ‘মই’ চিহ্নে। ভোট পেয়েছেন ২৪৫৯টি। আর তিন নম্বরে নেমে যাওয়া অমিত ১৯৮৫টি। এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘মই চিহ্নই তো তৃণমূল প্রার্থীর পাকা ধানে মই দিয়ে গেল।’’

১৩ নম্বরে নাজিরুদ্দিন ওরফে চাঁদুর ওয়ার্ডেও জনৈক নির্দল ৩২৯টি ভোট পেয়েছেন। সেখানে চাঁদু হেরেছেন ৩৩৭ ভোটে! প্রার্থীর অভিমান উপচে পড়বে, স্বাভাবিক। ঘরের মাঠে হারের পর ভরদুপুরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদু ম্লান হাসলেন, ‘‘অন্তর্ঘাতের কথাটা আমি উড়িয়ে দিতে পারছি না।’’ নিউটাউনের যে বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের তিনি ঘনিষ্ঠ, তাঁর আর এক ঘনিষ্ঠ শাহনওয়াজ আলি মণ্ডল ওরফে ডাম্পি কিন্তু ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ভোটে রইরই করে জিতেছেন। তা হলে চাঁদু কী দোষ করলেন?

আবার ঢুঁ মারতে হল স্থানীয় তৃণমূলের অন্দরে। জানা গেল, চাঁদুকে নিয়ে নাকি দলের একটা অংশের আপত্তি ছিল। এবং ডাম্পির হয়ে নাকি সিন্ডিকেটের পাণ্ডারা নেমেছিল (যে অভিযোগ তিনি পত্রপাঠ উড়িয়েছেন), কিন্তু চাঁদুর কপালে তা জোটেনি। আর সব্যসাচীও নিজের ওয়ার্ড সামলাতে গিয়ে চাঁদুর দিকে তেমন তাকাতে পারেননি।

এই হল চার ফুলের ঝরে যাওয়ার গপ্পো (আড়ালে অবশ্য কেউ কেউ এঁদের ডাকছেন ‘চার অভাগা’ নামে)। বিধাননগরে মমতার সেনাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ভোট সংক্রান্ত খুঁটিনাটি রিপোর্ট ছাড়া কোনও হার-টারের বিশ্লেষণ করতে রাজি নন। তবে দলের নেতাদেরই অনেকে বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস, এত কিছু টিভিতে দেখানোর পর ৪১-০ হলে খুব বেকায়দায় পড়ে যেতাম।’’

হারের কাঁটা ফুটেছে। তবু ঝরা ফুলেরাই এখন দলের ‘মুখরক্ষার’ চার মুখ। সান্ত্বনা বলতে এটুকুই!

four stalwart candidate stalwart candidate tmc candidate lost saltlake tmc candidate lost tmc candidate defeated frustrated tmc candidate abpnewsletters kuntak chattopahdyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy