Advertisement
E-Paper

পিঠ চাপড়ানিই সার, বিয়ে ভাঙা সেই নাবালিকাদের যেতে হল স্বামীর ঘরেই

ভেসে গিয়েছে প্রতিবাদ।পড়তে চেয়ে নিজেদের পরিবার, সমাজের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস দেখিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে রুখে দিয়েছিল তারা। খবরের কাগজে নাম বেরিয়েছিল। বাহবা জুটেছিল। মিলেছিল নানা আশ্বাস। ব্যস্।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০৩:১৫

ভেসে গিয়েছে প্রতিবাদ।

পড়তে চেয়ে নিজেদের পরিবার, সমাজের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস দেখিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে রুখে দিয়েছিল তারা। খবরের কাগজে নাম বেরিয়েছিল। বাহবা জুটেছিল। মিলেছিল নানা আশ্বাস। ব্যস্।

সময় গড়াতেই প্রতিবাদের ধার কমলো। ওরা তখন পাশে পেল না কাউকে। পরিণতিও হল একই। পুরুলিয়ার সরস্বতী সিংহ মুড়া, মুর্শিদাবাদের মনোয়ারা খাতুন, সুতির টুম্পা খাতুন বা বীরভূমের রিম্পা বাগদি। আঠারো পেরনোর আগেই বিয়ে হয়ে গেল প্রত্যেকের। যারা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল, তারাই এখন বইখাতা থেকে শত হস্ত দূরে সংসার ঠেলছে। সরস্বতী তো এখন এক ছেলের মা। সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তারাও মানছেন, রেখা বা বীণা কালিন্দীরা সত্যিই হাতেগোনা ব্যতিক্রম।

রাজ্যের গ্রামগঞ্জে যে সব নাবালিকা নিজেদের বিয়ে রুখে এক সময় নজির তৈরি করেছিল, তাদের নিয়মিত ‘ফলো-আপ’-এ রাখা, অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত তারা যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে সেই দায়িত্ব নেওয়া এবং ১৮ বছরের পরে মোটামুটি কোনও রুজির পথ কি সরকার দেখাতে পারে না? সেখানে বড় ফাঁক থাকাতেই কি ওই সব মেয়েদের প্রতিবাদ সহজে ভেসে গেল? দারিদ্র, সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাবের পাশাপাশি সরকারি উদাসীনতাও কি এই মেয়েদের হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ নয়? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠছে।

২০১১ সালে বাঘমুণ্ডির এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল পুরুলিয়ার কোটশিলা থানার বেগুনকোদর সুপুরডিহি গ্রামের সরস্বতী সিংহ মুড়ার। সরস্বতী তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। থানায় গিয়ে সব জানিয়ে বিয়ে ভেস্তে দিয়েছিল। আরও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিছুটা অর্থসংস্থান করতে চেয়েছিল পরিবারের জন্য। কিন্তু প্রতিবাদ দু’বছরের বেশি টিকিয়ে রাখতে পারেনি সে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পনেরো বছর বয়সেই কোটশিলার কাঁরিয়র গ্রামের অশোক মুণ্ডার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। নাবালিকা অবস্থায় মা-ও হয় সে।

সরস্বতী বলে, ‘‘আমরা চার বোন। বাবার সামান্য জমি। দু’বেলা খাবার জুটত না। পড়ার জন্য বইখাতা, স্কুলের ইউনিফর্ম, টিউশনের খরচ। সবের জন্য টাকা দরকার। কী করে হবে? পাড়ার লোক বাড়িতে আইবুড়ো মেয়ে রেখে দেওয়ার জন্য বাবাকে কথা শোনাত। আর না করার সাহস পেলাম না গো।’’ এখনও কি পড়তে চাও? বা পড়া শেষে চাকরি? অনেক ক্ষণ থেমে সরস্বতী বলে, ‘‘মাধ্যমিকও পাশ করলাম না। কে চাকরি দেবে?’’

মুর্শিদাবাদের মনোয়ারা খাতুনও বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। হরিহরপাড়া ব্লকের চুয়া পাঠানপাড়া গ্রামের জনমজুর ইমাম আলি শেখের ছোট মেয়ে মনোয়ারা। সে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, সেই ১৩ বছর বয়সে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। থানায় অভিযোগ জানিয়ে এসেছিল মনোয়ারা। সে পড়তে চায়, ফুটবল খেলতে চায়। ফুটবল তার প্রাণ। সেই মনোয়ারার বিয়ে হয়ে গেল মাস দু’য়েক আগে। ১৬ বছর বয়সে। বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে মাহমদপুরে। বিয়ের ঠিক পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে মনোয়ারা আর ওর স্বামী বাবিন শেখ—দু’জনেই। কিন্তু এর পরে আর পড়তে পারবে কিনা, আদৌ কখনও ফুটবলে পা ঠেকাতে পারবে কি না, জানে না মনোয়ারা। যে মেয়ে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে ঠেকাল, সে ১৬ বছরে কেন পারল না? মনোয়ারার অভিযোগ, কন্যাশ্রীর ফর্ম পূরণ করে জমা দিলেও আজও টাকা পায়নি সে। ভেবেছিল, ভাল ফুটবল খেললে কিছু কাজ পাবে। তা-ও হয়নি। হতাশ মনোয়ারার কথায়, ‘‘খালি পেটে পড়াও হয় না, খেলাও যায় না। বিয়ে না করার সাহস দেখাতে পারলাম না।’’

একই কাহিনি বীরভূমের আঙ্গারগড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কবিরপুর গ্রামের রিম্পা বাগদির। সে পড়ত কেদারপুর ভবানন্দ হাইস্কুলে। ২০১৩ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা প্রথম তার বিয়ে ঠিক করেন। রুখে দেয় রিম্পা। কয়েক মাসের মাথায় এক আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার বিয়ে দেওয়া হয়। এখনও ১৮ হয়নি। এর মধ্যে একবার গর্ভপাত হয়ে গিয়েছে।

মুর্শিদাবাদের সুতি-২ ব্লকের রঘুনাথপুরের জরি শ্রমিক মোয়াজ্জেম হোসেন ও সানোয়ারা বিবির মেয়ে টুম্পা খাতুন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে রুখেছিল। দেড় মাস আগে, দশম শ্রেণিতে ওঠার পরেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার। টুম্পা বলে, ‘‘আট ভাইবোন আমরা। বাবা আর সংসার চালাতে পারছিল না। আমি কন্যাশ্রীর ফর্ম ফিলাপ করতে একটু ভুল করেছিলাম। তাই টাকাও আসছিল না। বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হল। ’’

কেন এমনটা হচ্ছে? রাজ্যের শিশুকল্যাণ পরিষদের প্রধান অশোকেন্দু সেনগুপ্তর বক্তব্য, বাল্যবিবাহ আটকালে মেয়েরা উৎসাহ-ভাতা পায় না। তা ছাড়া, সব জেলায় প্রশাসন একই ভাবে উদ্যোগী হয়ে এই মেয়েদের সরকারি টাকায় হস্টেলে থাকা-খাওয়া, পড়াশোনা, জামা-কাপড়ের ব্যবস্থাও করে না। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘দারিদ্রে হাবুডুবু খাওয়া প্রান্তিক মেয়েরা কত দিন আর একতরফা লড়াই চালাতে পারবে?’’

নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধ আর তাদের স্কুলছুট হওয়া রুখতেই রাজ্য সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছে। তা সত্ত্বেও কেন সরস্বতী, মনোয়ারা, টুম্পাদের আঠারো হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে? প্রকল্পে কি তা হলে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে? ইঙ্গিতটা কিন্তু সে রকমই দিয়েছেন অশোকেন্দুবাবু এবং নারী-আন্দোলনকর্মী কর্মী বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়। কন্যাশ্রীতে এত দিন বছরে ৫০০ টাকা মিলত। সম্প্রতি তা ৭৫০ হয়েছে। ১২ মাসের নিরিখে এই টাকা অত্যন্ত কম বলে মনে করছেন অশোকেন্দুবাবু, বৈতালিদেবীরা। তাঁদের ব্যাখ্যা, কন্যাশ্রী প্রকল্প অনুযায়ী, আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বিয়ে না করে যদি মেয়েরা পড়াশোনা করে তা হলে ২৫ হাজার টাকা মেলে। কিন্তু গাঁ-গঞ্জের গরিব মেয়েগুলো আঠারো পৌঁছনোর আগেই জীবনযুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠছে। আত্মসমর্পণ করছে। ভেসে যাচ্ছে প্রতিবাদ।

early marriage education
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy