টানা চার দিন ছুটির হাতছানি ছিল। সেই মতো অনেকে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সরকারের ‘এক দিনের বেতন কাটা’-র ফরমান পেয়ে আর ঝুঁকি নিতে চাননি প্রায় কেউই। ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। বৃহস্পতিবার বামেদের ডাকা ১২ ঘণ্টা সাধারণ ধর্মঘটের দিন রাজ্য প্রশাসনের সদর কার্যালয় নবান্ন, মহাকরণ, খাদ্য দফতর-সহ শহরের প্রায় সব অফিসেই কর্মীদের হাজিরা ছিল অন্য দিনের মতোই। কলকাতা পুরসভার ছবিটাও একই ছিল। কিছুটা হলেও তাল কেটেছে সল্টলেকে। তবে সর্বত্রই দুপুরের পরে কাউকে আর অফিসে আটকে রাখা যায়নি।
বন্ধ বা ধর্মঘট যে দলই ডাকুক, অতিরিক্ত এক দিন ছুটি পেলে অধিকাংশই অফিস-মুখো হবেন না — এটাই এ রাজ্যে সরকারি কর্মীদের দস্তুর। এ বার শুক্রবার থেকে রবিবার টানা তিন দিন ছুটি থাকায় বৃহস্পতিবার ধর্মঘটে অফিস না করাতেই বাড়তি উৎসাহ ছিল। তাতে বাধ সেধেছে সরকারি বিজ্ঞপ্তি। অনেকের মতে, বাম আমলে ধর্মঘটের দিন অফিস
না করলে একটা ছুটি কাটা যেত। নতুন জমানায় ২০১২ সাল থেকে ছবিটা বদলে যায়। সে বার বিজ্ঞপ্তি জারি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, বন্ধের দিন না এলে এক দিনের বেতন কেটে নেওয়া হবে, সংশ্লিষ্ট কর্মীকে ‘শো-কজ’ করা হবে, এমনকী তাঁর চাকরিজীবন এক দিন কমে যাবে।
সেই ফরমান দেখিয়েই এ বার কর্মীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাতে তাল মিলিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বিভিন্ন মন্ত্রী এবং সরকারের বড়-মেজো-ছোট কর্তারাও। কর্মীদের কথায়, ‘‘এই অবস্থায় আমরা আর ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’ অন্য দিনের তুলনায় এ দিন লোকাল ট্রেন কম চলেছে।
ট্যাক্সি প্রায় ছিলই না। অটো ও বেসরকারি বাস হাতে গোনা। সরকারি বাসও মিলেছে দীর্ঘ সময় অন্তর।
এত বাধা, তবু সরকারি দফতরে হাজিরা ছিল নজরকাড়া।
কর্তাদের দাবি, কর্মীদের উপস্থিতি ছিল ৮০-৮৫ শতাংশ।
কেমন ছিল বিভিন্ন অফিসের ছবি?
নবান্ন
মুখ্যমন্ত্রী আসেন ৩টে নাগাদ। কিন্তু নবান্নের ১৪ তলা বাড়ি সকাল সাড়ে দশটা থেকেই কর্মীদের উপস্থিতিতে ছিল সরব। হাজির ছিলেন অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী এবং দমকল মন্ত্রীও। এক কর্তা জানান, বুধবার কোনও কোনও দফতরে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কর্মীদের সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার ফল হাতেনাতে পাওয়া গিয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, নবান্নে সাধারণ দিনে উপস্থিত থাকেন ৮০ শতাংশ কর্মী। বেতন কাটার ভয়ে এ দিন সেই হিসেবও ছাপিয়ে গিয়েছে। কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের দাবি, নবান্ন-সহ কলকাতার সমস্ত সরকারি অফিসে হাজিরা ছিল ৯৫ শতাংশের উপরে। যদিও পুলিশের মতে, নবান্নে ৮০ শতাংশ কর্মী হাজির ছিলেন। উপস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কোনও দফতরেই প্রায় কাজ হয়নি। চা-টিফিন খেয়ে, গল্পগুজব করে অধিকাংশই অফিস ছেড়েছেন দুপুর-দুপুর। রাতে নবান্ন থেকে বেরোনোর সময় মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কর্মীদের অভিনন্দন জানান।
মহাকরণ
বিবাদী বাগের এই লালবাড়ি থেকে সদর দফতর চলে গিয়েছে বছর দেড়েক আগে। তার পর থেকে মহাকরণ কার্যত ভাঙা হাট। শুধু পূর্ত, কৃষি, বিদ্যুৎ ও পুর দফতরের মতো কয়েকটি ছড়িয়ে রয়েছে। এ দিন বেলার দিকে সেখানে উপস্থিতি ভালই ছিল। কিন্তু বিকেল না হতেই সব দফতরই প্রায় কর্মী-শূন্য হয়ে পড়ে। কর্মী-উপস্থিতির হার দেখে খুশি পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্ম সংস্কৃতিকে স্বাগত জানাতেই কর্মীরা এ দিন হাজির হয়েছেন।’’ মন্ত্রীর বক্তব্য উড়িয়ে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোজ গুহ অবশ্য দাবি করেন, ‘‘মহাকরণে এসেছেন মাত্র শ’খানেক কর্মী।’’ তিনি জানান, ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটে গরহাজির থাকায় সরকার বহু কর্মীর বেতন কেটে নেয়। তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। সরকারি কর্মচারি ফেডারেশনের আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাসের অবশ্য দাবি, ‘‘অনেকে ছুটি বাতিল করে কাজে এসেছেন।’’
বিধানসভা
এ দিন বিধানসভার কাজকর্ম স্বাভাবিক ছিল বলে জানিয়েছেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভার বিভিন্ন কমিটির বৈঠকও নির্ধারিত সূচি মেনে হয়েছে। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া জানান, বিধানসভার আশ্বাসন কমিটির বৈঠক ডাকা ছিল। সেই বৈঠক করেছি।
কলকাতা পুরসভা
সরকারি বিজ্ঞপ্তির গুঁতোয় সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই অধিকাংশ কর্মী হাজির হন। স্বাস্থ্য, বিল্ডিং, জল সরবরাহের মতো সব দফতরেই ছবিটা অন্য দিনের থেকে আলাদা ছিল না। পুরসভার সচিব হরিহরপ্রসাদ মণ্ডলের দাবি, ‘‘কর্মী হাজিরার হার ৯০ শতাংশ ছুঁয়েছে।’’ সকালে পুরসভার মূল ফটকে তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আইএনটিটিইউসি সমর্থিত কর্মী ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বন্ধ- বিরোধী স্লোগান দেন। কিন্তু সরকারি নির্দেশিকার কারণেই কি কর্মীদের হাজিরা এত বেশি? জবাবে কেউ মুখ না খুলে হেসে পাশ কাটিয়েছেন।
সল্টলেক
রাস্তায় প্রচুর পুলিশ ছিল। ছিল শাসক দলের সক্রিয় কর্মী-বাহিনীও। কিন্তু অন্য দিনের মতো মানুষ কোথায়? সারা দিন এই প্রশ্নই ঘুরল সল্টলেক এবং পাঁচ নম্বর সেক্টরের অফিসপাড়ায়। এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় বিকাশ ভবনের সর্বশিক্ষা অভিযান দফতর যখন গমগম করছে, তখন ওই ভবনেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অফিসে বিপরীত চিত্র। সেখানে রুম নম্বর ৯-এ দু’জন নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি। মিনিট দশ পরে অবশ্য এক জনের দেখা মিলল। সহকর্মীরা কোথায়? তাঁর দাবি, সকলেই এসেছেন। অনেকেই কাজে সংসদের মূল ভবনে গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কত জন এলেন? স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিব অর্ণব রায় কোনও তথ্য জানাতে রাজি হননি। সল্টলেকের নির্মাণ (সেচ), জলসম্পদ, ময়ূখ, পূর্ত ও উন্নয়ন ভবন থেকে পাঁচ নম্বর সেক্টরের স্বাস্থ্য ভবনে উপস্থিতির ছবিটাও একই। তবে মৎস্য দফতরে হাজিরা ছিল স্বাভাবিক। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অন্য দিনের চেয়েও বেশি কর্মী এসেছেন।’’
দাবি, পাল্টা দাবির মধ্যেই বিকাশ ভবন চত্বরে এক দোকানির আক্ষেপ, ‘‘অন্য দিনের চেয়ে আমার পাউরুটি বিক্রি অর্ধেক হয়েছে। পাঁচ নম্বরে তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের ছবিটা আরও করুণ। দুপুর ১টায় এসডিএফ বিল্ডিংয়ের সামনেটা যেন ভাঙা হাট। এক লস্যি বিক্রেতার কথায়, ‘‘অন্য দিন গড়ে ২০০০ টাকার বিক্রি হয়। আজ ২৫০ টাকাও হয়নি।’’ এ দিন সকালে বাম ও বিজেপির কর্মীরা সল্টলেকে মিছিল করেন। করুণাময়ীর মোড়ে বিজেপি অবরোধ করতে গেলে পুলিশ হঠিয়ে দেয়। অন্য দিকে শাসক দলের এক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে বাইকবাহিনী অফিসপাড়া চষে বেড়ায়। ময়দানে বিশেষ লোক নেই দেখে তারাও এক সময় চলে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy