Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
গোলমাল সামাজিক সুরক্ষা ফর্ম নিয়েই

অফিসার অন্তর্ধানে কাঠগড়ায় নেতা

মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল রাত সাড়ে ১১টায়। পরের দিন সকালে ছেলেকে বারবার ফোন করেও সাড়া পাননি মা। দুপুরের পরে ফোনটাই ‘সুইচড অফ’ হয়ে যায়। তার তিন সপ্তাহ পরেও ছেলের হদিস নেই। ছেলে অপহৃত হয়েছেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে অসহায় পরিবার।

সুমিতকুমার ভট্টাচার্য। (ডান দিকে) নিজের বাড়িতে মা কল্পনা ভট্টাচার্য। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

সুমিতকুমার ভট্টাচার্য। (ডান দিকে) নিজের বাড়িতে মা কল্পনা ভট্টাচার্য। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

দেবাশিস দাশ ও বাপি মজুমদার
হাও়ড়া ও চাঁচল শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪০
Share: Save:

মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল রাত সাড়ে ১১টায়। পরের দিন সকালে ছেলেকে বারবার ফোন করেও সাড়া পাননি মা। দুপুরের পরে ফোনটাই ‘সুইচড অফ’ হয়ে যায়। তার তিন সপ্তাহ পরেও ছেলের হদিস নেই। ছেলে অপহৃত হয়েছেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে অসহায় পরিবার। এই ঘটনায় আঙুল উঠছে চাঁচলের এক তৃণমূল নেতার। সেই নেতা অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ওই ছেলে হলেন মালদহের চাঁচল মহকুমার সহকারী শ্রম কমিশনারের দফতরের অধীন শ্রমিক সহায়তা কেন্দ্রের ইনস্পেক্টর সুমিতকুমার ভট্টাচার্য। রাজ্যের এক আইপিএস অফিসারের পিসতুতো ভাই। কর্মসূত্রে চাঁচলের আমলাপাড়ায় সুদেব দাস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সুমিত। হাওড়ার জগাছার বাড়িতে আছেন তাঁর স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মা। বাবা মারা গিয়েছেন।

পরিবারের লোকেরা জানান, প্রতি শুক্রবার বাড়ি আসতেন সুমিত। রবিবার রাতের ট্রেনে ফিরে যেতেন চাঁচলে। ১২ ডিসেম্বরও বাড়ি এসেছিলেন। যদিও সে-দিন ছিল শনিবার। ১৪ ডিসেম্বর, সোমবার রাতে কর্মস্থলে ফেরার জন্য ব্যান্ডেল স্থেকে ট্রেন উঠে মা ও স্ত্রীকে ফোন করেন সুমিত। সেটাই শেষ। তার পরে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গিয়েছেন তিনি! পুলিশের খবর, ব্যান্ডেলের পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যায়নি। বাড়ির লোকজন শেষ পর্যন্ত জগাছা থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন।

বছর চল্লিশের সুমিত গেলেন কোথায়? পুলিশের কাছে জবাব নেই। তবে চাঁচলে কান পাতলে এই ঘটনার সঙ্গে সামিউল ইসলাম নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার কথা উঠে আসছে। তদন্তে নেমে জগাছা থানার পুলিশ জেনেছে, কয়েক মাস আগে ওই তৃণমূল নেতার সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের শতাধিক ফর্ম নিয়ে গোলমালে জড়িয়ে পড়েন সুমিত। অভিযোগ ওঠে, ওই নেতা জোর করে সুমিতের সই করা ফর্ম ছিনিয়ে নেন। সব জানিয়ে চাঁচল থানায় ওই নেতার বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় অভিযোগ করেন সুমিতের দফতরের আধিকারিক। তবু পুলিশ ওই নেতাকে গ্রেফতার করেনি। কেন? ‘‘আমরা কিছু তথ্যের সন্ধানে আছি। কয়েক জনকে সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত চলছে,’’ বললেন হাওড়ার পুলিশ কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ।

শাসক দলের ওই নেতার

সঙ্গে বিরোধের পর থেকেই সুমিত মারাত্মক মানসিক চাপে ছিলেন বলে পরিবারের লোকজন পুলিশকে জানিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি সুমিতের অন্তর্ধানের সঙ্গে ওই ঘটনার কোনও যোগাযোগ আছে? নাকি ‘মানসিক চাপে’ থাকা সুমিত আত্মঘাতী হয়েছেন?

ছেলের আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা মানতে রাজি নন সুমিতের মা কল্পনাদেবী। তিনি জানান, এটা ঠিকই যে, চাঁচলের তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে ওঁর দফতরের তরফে অভিযোগ দায়ের করার পর থেকে উনি খুব আতঙ্কে ছিলেন, চাপেও ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ১২ ডিসেম্বর বাড়ি আসার পরে সুমিত মাকে বলেছিলেন, চাঁচল ফিরতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। বারবার বলছিলেন, ওরা (নেতার লোকজন) ছাড়বে না। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওকে পুলিশে দেবে। ‘‘আমরা বোঝালেও ও কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ও কেন এমন করছে। তবে এই সব কারণে ছেলে আত্মঘাতী হবে, তা মনে হয় না,’’ বললেন কল্পনাদেবী।

এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে সরকারি

ফর্ম ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ, সরকারি অফিসারকে অপহরণের অভিযোগে জগাছা থানায় ডায়েরির পরেও চাঁচলের পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার! সরকারি সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শাসক দলের ওই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন?

চাঁচলের এসডিপিও রানা মুখোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘তদন্তে যে-সব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে, সেগুলোর মীমাংসা না-হওয়া পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। দেখা যাক, কী হয়।’’ চাঁচল পুলিশের দাবি, ফর্ম ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আসার পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুমিতকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি দেখা না-করায় মামলা আর এগোয়নি। চাঁচলের মহকুমাশাসক জয়ন্ত মণ্ডল বলেন, ‘‘ঘটনার পরে প্রশাসনের তরফেও তদন্ত করা হয়। সেখানে প্রাথমিক ভাবে ফর্ম ছিনতাইয়ের প্রমাণ মেলেনি।’’ কিন্তু তৃণমূল নেতা তো জোর করে ওই অফিসারকে দিয়ে ফর্মে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে থাকতে পারেন? ‘‘সেটাই তো পুলিশ দেখছে,’’ জবাব এসডিও-র।

কী বলছেন অভিযুক্ত নেতা?

‘‘আমি সে-দিন কিছুই করিনি। পরে শুনি, আমার নামে অভিযোগ করা হয়েছে। এটাও শুনেছি, ওই অফিসার নিখোঁজ। কিন্তু এর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? কেউ কোথাও আত্মহত্যা করলে বা নিখোঁজ হয়ে গেলে তার দায় কি আমার,’’ পাল্টা প্রশ্নে জবাব দেন সামিউল ইসলাম।

যিনি তৃণমূল নেতার নামে থানায় অভিযোগ করেছিলেন, চাঁচলের সেই সহকারী শ্রম কমিশনার দেবু কর বলেন, ‘‘কী হয়েছিল, তা পুলিশকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। বাকিটা পুলিশের ব্যপার।’’ সুমিত কি কোনও রকম চাপে ছিলেন? ভেঙে পড়েছিলেন মানসিক ভাবে? দেবুবাবু বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পরে সুমিতবাবুকে কিন্তু সে-ভাবে বিপর্যস্ত মনে হয়নি। উনি কী ভাবে, কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেলেন— তা বোধগম্য হচ্ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE