প্রতীকী ছবি।
সরকারি নির্দেশ যদি মানা হতো, তা হলে বিষ্ণুপুরের আইচবাড়ি গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর অরূপ মাজি কোনও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারতেন। জমি বন্ধক রেখে আট হাজার টাকা অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া আর বেসরকারি হাসপাতালে এক সপ্তাহে পঁচাশি হাজার টাকা দিতে হত না তাঁকে।
পঞ্চমীর দিন স্বাস্থ্য দফতর থেকে ‘স্থায়ী রেফারাল কন্ট্রোল রুম’ সংক্রান্ত নির্দেশ জারির পরেও দিনমজুর অরূপ মাজির মতো অসংখ্য রোগীর দুর্দশায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি।
সরকারি হাসপাতালগুলিতে অকারণে রোগীদের অন্যত্র ‘রেফার’ করার প্রবণতা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। রেফারের ফলে রোগীদের হেনস্থা ও তাঁদের বাড়ির লোকেদের ভোগান্তিতে রাশ টানার জন্য স্থায়ী কন্ট্রোল রুমের পরিকল্পনা হয়েছিল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া নির্দেশে বলা হয়েছিল, ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীকে যদি একান্ত রেফার করতেই হয়, তা হলে যে হাসপাতাল রেফার করছে, তারা তৎক্ষণাৎ কন্ট্রোল রুমে তার কারণ জানাবে। যেখানে রেফার করা হচ্ছে, সেই হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাম্বুল্যান্স দিয়ে রোগীকে সেখানে পাঠানো হবে। প্রথম দফায় সব ক’টি মেডিক্যাল কলেজে এবং জেলা স্তরে হাওড়া হাসপাতাল, এম আর বাঙুর ও বারাসত হাসপাতালে এটি চালু হয়েছিল।
কিন্তু এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই স্বাস্থ্য ভবনের একাধিক কর্তা এবং অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছেন, গোটা পরিকল্পনাটাই কার্যত ফাঁকিবাজিতে চলছে। কারণ, মস্ত পরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু তা বাস্তবায়িত করার ও নজরদারি চালানোর পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। রোগী রেফার দেদার চলছে এবং কার্যত কোনও হাসপাতালই স্বাস্থ্য ভবনকে সে সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাচ্ছে না। স্বাস্থ্য ভবনের হাতে এমন কোনও নজরদারির ব্যবস্থাও নেই, যা দিয়ে এই ফাঁকি ধরা যায়।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর পথ দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর চোট পাওয়া বছর সাতাশের অরূপ মাজিকে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে বাড়ির লোক নিয়ে আসেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে শুরু হয় রেফার। বাঁকুড়া থেকে এসএসকেএম, সেখান থেকে ন্যাশনাল ও নীলরতনে ঠোক্কর খেয়ে শেষ পর্যন্ত পার্ক সার্কাসের এক নার্সিংহোম। আত্মীয় বিশ্বজিৎ ঢাক বলেন, ‘‘আর টানতে পারছি না।’’ স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তাই মানলেন, ‘‘অরূপ এখানে অসংখ্য ভুক্তভোগী রোগীর প্রতীক।’’
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সির এক চিকিৎসক যেমন মঙ্গলবার বললেন, ‘‘আজকেও এসএসকেএম থেকে তিন জনকে এখানে রেফার করা হয়েছে। রেফার করার আগে ওরা আমাদের কিচ্ছু জানায়নি। স্বাস্থ্য ভবনে কাকে, কী জানাতে হবে, তা আমরাও জানি না। আমরাও রিপোর্ট করিনি।’’ এসএসকেএমের এক মেডিক্যাল অফিসারের কথায়, ‘‘এখন উৎসবের সময়ে ডাক্তার নেই, নার্স নেই। সবাই ছুটিতে। আমরা ইমার্জেন্সিতে পরিষেবা দেব, নাকি ক্ষণে-ক্ষণে স্বাস্থ্য ভবনে ফোন করব!’’
নীলরতনের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘তা হলে তো ইমার্জেন্সিতে এমন এক জনকে বসিয়ে রাখতে হয়, যাঁর কাজই হবে শুধু স্বাস্থ্য ভবন আর বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার নিয়ে ফোন করা। এখানে বেডের অভাব, আইটিইউ-এর অভাব। সে সব না মিটিয়ে এই লোক দেখানো নিয়মের অর্থ কী?’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের মতে, ‘‘এত অ্যাম্বুল্যান্স কোথায়, যার মাধ্যমে রেফার হওয়া রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হবে? আমরা চিকিৎসা করব, নাকি এই সব ব্যবস্থা করব? তার থেকে স্বাস্থ্য ভবনের কন্ট্রোল রুমে রেফারের ব্যাপারে কিছু জানাবই না।’’
বছর দুই আগে রেফারাল রেজিস্ট্রি-র ব্যবস্থা চালু করার পরেও তা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এ বারেও কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে? স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর উত্তর, ‘‘কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছে।
যে কোনও নতুন ব্যবস্থা চালুর
পরে প্রথম প্রথম এমন হয়। আগামী ৯ তারিখের মধ্যে এমন নজরদারির ব্যবস্থা চালু হবে, যাতে কোনও রেফার আমাদের চোখের আড়ালে না থাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy