চিকিৎসক সুদীপ মহাপাত্র ও তাঁকে দেওয়া মাওবাদীদের সেই চিঠি। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।
সাদা পাতায় লাল কালির চিঠিতে লেখা, দু’লাখ টাকা চাই, না দিলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। প্রেরক: সিপিআই মাওবাদী! হাতে রিভলভার, গামছায় মুখ ঢাকা এক ব্যক্তি অন্ধকারে এক গ্রামীণ চিকিৎসককে ধরিয়ে দিয়েছে ওই চিঠি। ঘটনাস্থল, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির চ্যাংশোল গ্রাম। একদা যা মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল বলে পরিচিত। ওই চিঠি থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে অবধারিত প্রশ্ন— বনপার্টি কি ফিরে এল?
রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে মাওবাদী কার্যকলাপ তলানিতে ঠেকলেও মাওবাদী নামাঙ্কিত পোস্টার পড়া বন্ধ হয়নি। কিন্তু বন্দুক দেখিয়ে তোলা চেয়ে লেখা ‘মাওবাদী-চিঠি’ হাতে ধরিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনা ২০১১-র নভেম্বরে কিষেণজি নিহত হওয়ার পরে ঘটেনি। চিঠিতে বলা হয়েছে, জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদীদের সংগঠন তৈরি করা হচ্ছে। আর তাই ওই টাকা লাগবে। তবে সত্যিই মাওবাদীরা আবার সক্রিয় হয়েছে, নাকি মাওবাদীদের নামে কেউ রোজগার করার চেষ্টা করছে, তা নিয়ে পুলিশ এখন ধন্দে।
ওই চিকিৎসকের নাম সুদীপ মহাপাত্র। ঘটনাটি ১৪ ফেব্রুয়ারির। সুদীপের বয়ান অনুযায়ী, তাঁর হাতে চিঠি গুঁজে রিভলবার দেখিয়ে হুমকি দিয়ে এক আগন্তুক বলে, ‘‘কাগজে যা লেখা আছে, তা অক্ষরে অক্ষরে মানা না-হলে গুলি খেয়ে মরতে হবে।’’ তবে ওই চিকিৎসক শালবনি থানার পিরাকাঁটা ফাঁড়িতে অভিযোগ দায়ের করেছেন ১০ মে। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরে কেন?
সুদীপবাবুর কথায় ইঙ্গিত, অত টাকা জোগাড় করতে না পেরে গ্রামীণ চিকিৎসকদের সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর পরামর্শে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন। তার অনেক আগে, চিঠি পাওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মাওবাদী লিঙ্কম্যান ঠাউরে পাশের গ্রাম মৌপালে পিন্টু মাহাতো নামে এক যুবককে তিনি ২০ হাজার টাকা দেন। তবে পিন্টুকে এখন ওই তল্লাটে দেখা যাচ্ছে না। চ্যাংশোলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর শিবির থেকে একশো মিটারের মধ্যে সুদীপ মহাপাত্রের বাড়ি। সেখানে বসে উদ্বিগ্ন সুদীপবাবু বলেন, ‘‘আমি গরিব। মাসে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা রোজগার। জমি দু’বিঘা। দু’লাখ টাকা চোখেই দেখিনি।’’
চিঠি পাওয়ার পরে সুদীপবাবু যোগাযোগ করেন পিন্টুর সঙ্গে। মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে পিন্টু জেলও খেটেছে। সুদীপবাবুকে পিন্টু জানায়, মাওবাদী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সে টাকার অঙ্ক কিছুটা কমানোর চেষ্টা করবে। সুদীপবাবু জানান, ১৮ ফেব্রুয়ারি পিন্টু এসে বলে, মাওবাদী নেতা আকাশের সঙ্গে কথা বলে ৩০ হাজারে রফা হয়েছে। বাকি অন্তত এক লাখ টাকা ভোটের পরে মেটাতে হবে। কারণ, আকাশ নতুন ভাবে সংগঠন তৈরি করছেন।
এর পরেও টাকা দেওয়া নিয়ে দোলাচলে ছিলেন সুদীপবাবু। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি মৌপাল, জলহরি, চ্যাংশোলের বিভিন্ন জায়গায় মাওবাদী নামাঙ্কিত আরও পোস্টার পড়ে। ভয়ে ওই দিনই ধান বিক্রি করে পিন্টুকে ২০ হাজার টাকা দেন তিনি। সুদীপবাবুর দাবি, পিন্টু তাঁকে জানায়, মৌপালের এক ব্যবসায়ী এবং ভুরসা-জলহরি ও চ্যাংশোলের তিন রেশন ডিলারের থেকেও টাকা নেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রেও খবর, মাওবাদী নেতা আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডল নতুন করে সংগঠন তৈরি করতে চাইছে। কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়া মাওবাদী নেতা বিকাশের কাছ থেকেও জানা গিয়েছে, আকাশ ক্যুরিয়র মারফত তার কাছে হাজার দশেক টাকা পাঠায় ও চিঠি লিখে ফের দলের কাজে সামিল হতে আহ্বান জানায়। কিন্তু এক গোয়েন্দা অফিসারের বক্তব্য, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের জনসমর্থনের ভিত্তি হারানোর অন্যতম কারণ, গরিব মানুষের কাছ থেকে তোলা আদায়। সেই ভুল মাওবাদীরা ফের করবে কেন, সেটাই গোয়েন্দাদের প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy