Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নিশানায় স্থানীয় তৃণমূল

বন্দুক-গুলির আশ্বাসেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়

খাগড়াগড়ে গ্রেনেড ও বুলেট তৈরির কারিগরদের সঙ্গে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের একাংশের আঁতাঁত ছিল বলে আঁচ পেয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, ভোটের সময়ে বা এলাকা দখলের লড়াইয়ের আগে চাহিদা মতো গুলি ও বিস্ফোরকের জোগান পাওয়া যাবে, এই শর্তে শাসক দলের কয়েক জন স্থানীয় নেতা বর্ধমানের উপকণ্ঠে হাসান চৌধুরীর ওই বাড়ির দোতলায় বোমা-বারুদের গবেষণাগার তৈরির জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং সেখানে বসে নির্বিঘ্নে কাজ করা যাবে, এই আশ্বাসও দিয়েছিলেন।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

খাগড়াগড়ে গ্রেনেড ও বুলেট তৈরির কারিগরদের সঙ্গে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের একাংশের আঁতাঁত ছিল বলে আঁচ পেয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।

এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, ভোটের সময়ে বা এলাকা দখলের লড়াইয়ের আগে চাহিদা মতো গুলি ও বিস্ফোরকের জোগান পাওয়া যাবে, এই শর্তে শাসক দলের কয়েক জন স্থানীয় নেতা বর্ধমানের উপকণ্ঠে হাসান চৌধুরীর ওই বাড়ির দোতলায় বোমা-বারুদের গবেষণাগার তৈরির জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং সেখানে বসে নির্বিঘ্নে কাজ করা যাবে, এই আশ্বাসও দিয়েছিলেন। গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই বোঝাপড়ার বলে বলীয়ান হয়েই তিন মাস ধরে বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে, খাগড়াগড়ের মতো জনবহুল এলাকায় নিশ্চিন্তে ও নিরুদ্বেগে আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস), গুলি ও খেলনা-বোমা তৈরি করে গিয়েছিল শাকিল, সুবহান, হাকিমরা।

প্রসঙ্গত, এই বিস্ফোরণ-কাণ্ড ঘটার আগেই বাংলাদেশ সরকারের তরফে দিল্লিকে জানানো হয়েছিল যে, রাজ্যের শাসক দলের স্থানীয় কিছু নেতার আশ্রয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গাড়ছে জঙ্গিরা। রাজ্যের যে সব এলাকার তালিকা দিয়েছিল, তার গোড়ার দিকেই ছিল বর্ধমান শহরের নাম।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, খাগড়াগড়ে তৈরি আইইডি দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ছড়ানোর পাশাপাশি এ রাজ্যেও কলকাতা-সহ কয়েকটি জেলায় নাশকতার ছক ছিল জঙ্গিদের। বিশেষত মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলার অতি স্পর্শকাতর কয়েকটি এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর ছক ছিল বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। সে ক্ষেত্রে অন্য রকম গণ্ডগোল ও বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপিয়ে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে কোনও ফায়দা তোলার চক্রান্ত কেউ করেছিল কি না, সেটাও গোয়েন্দাদের প্রশ্ন।

তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে দাবি করেন, “ঘণ্টায় ঘণ্টায় নানা রকম দাবি করে বিরোধীরা প্রশাসনকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। জেলায় জেলায় অশান্তি বাধানোর চক্রান্ত হচ্ছে।” কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের সঙ্গে দলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের যোগসাজসের যে ইঙ্গিত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দিচ্ছেন এবং স্পর্শকাতর কয়েকটি এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর যে ছকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে পার্থবাবুর কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তাঁকে বার বার মোবাইলে ফোন করলেও বেজে গিয়েছে। এসএমএস করলেও উত্তর মেলেনি।

বর্ধমানে তৃণমূলের স্থানীয় কোন কোন নেতার সঙ্গে বোমা-গুলির কারবারি ও কারিগরদের সংস্রব ছিল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) নির্দিষ্ট ভাবে তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গোয়েন্দাদের দাবি, ধৃতদের জেরা করে শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে খাগড়াগড়ের কুশীলবদের আঁতাঁতের বিষয়টি কিছুটা জানা গেলেও নেতাদের পরিচয় নিয়ে ধৃত দুই মহিলা-সহ চার জন এখনও মুখ খোলেননি। ঘটনার পর থেকে অবশ্য মেহবুব রহমান নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা তেমন জনসমক্ষে আসছেন না বলেই স্থানীয় সূত্রে খবর। খাগড়াগড়ের ওই বাড়ির একতলার একটি ঘরকে তৃণমূলের নির্বাচনী কার্যালয় হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছিল এবং ভোট ছাড়া অন্য সময়েও মেহবুব রহমান কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে ওখানে বসতেন বলে তৃণমূল কর্মীদেরই একাংশের বক্তব্য। তাঁদের দাবি, মেহবুব রহমান জেলা যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি এবং খাগড়াগড়ের ওই তল্লাটে তিনিই শাসক দলের শীর্ষ নেতা। সিপিএমের অভিযোগ, খাগড়াগড়ের কাছে সিটু-র একটি অফিস দখল করে তাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বসানো হয়েছে ওই ব্যক্তির উদ্যোগে। স্থানীয় সূত্রের খবর, একটা সময়ে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর দল পিডিসিআই (পিপিলস ডেমোক্র্যাটিক কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মেহবুব। পরে যোগ দেন তৃণমূলে।

তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব এখন অবশ্য মেহেদিবাগানের বাসিন্দা, ঠিকাদারির কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ওই ব্যক্তির সঙ্গে দলের যোগ নেই বলে দাবি করতে শুরু করেছেন। তৃণমূলের বর্ধমান (গ্রামীণ)-এর সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, “মেহবুব রহমান এখন আর তৃণমূল বা যুব তৃণমূলের কোনও পদাধিকারী নন।” তবে কি তিনি তৃণমূলের সাধারণ কোনও সদস্য? স্বপনবাবুর জবাব, “না, উনি এখন তৃণমূলের কেউ নন, সদস্যও নন।” খাগড়াগড়-কাণ্ডের পরেই কি মেহবুব রহমানকে দলের কেউ বলে অস্বীকার করছে তৃণমূল? এ বার স্বপন দেবনাথের বক্তব্য, “মেহবুব রহমানকে নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করব না।”

যদিও তৃণমূলের কোনও স্থানীয় নেতার সঙ্গে ওই জেহাদি সন্ত্রাসবাদীদের যোগসাজস তদন্তে বেরোলে কী হবে, সেই প্রশ্ন করা হলে স্বপন দেবনাথ বলেছেন, “তদন্ত চলছে, তদন্তে যেমন তথ্য বেরিয়ে আসবে, সেই মতো আইনি ব্যবস্থা হওয়া উচিত।”

আইবি-র বক্তব্য, বর্ধমানের ওই জঙ্গি-ডেরায় যে নাইন এমএম পিস্তলের গুলি তৈরি হচ্ছিল, বাজেয়াপ্ত হওয়া জিনিসপত্র তার সাক্ষ্য আগেই দিয়েছে। ওই ধরনের গুলির ৬২টি ফাঁকা খোল পাওয়া গিয়েছে ঘটনাস্থল থেকে। মিলেছে বারুদও। তা ছাড়া, ধৃত রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিও জেরায় স্বীকার করেছেন, খাগড়াগড়ের ওই আস্তানায় পিস্তলের গুলি তৈরি করা হতো। আবার বিস্ফোরণে নিহত শাকিল জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর এক জন সদস্য এবং খাগড়াগড়ে তৈরি দেশি গ্রেনেডের একটা বড় অংশ যে বাংলাদেশে নাশকতার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে, তার ইঙ্গিত আইবি এবং সিআইডি দু’টি সংস্থার গোয়েন্দারাই পেয়েছেন।

কিন্তু আইবি-র এক অফিসারের প্রশ্ন, “বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে জেএমবি নিশ্চয়ই নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে লড়াই করতে যাবে না! আর ও দেশে গুলির প্রয়োজন মেটাতে বর্ধমানে এ ভাবে গোপনে সে সব তৈরি করার প্রয়োজন নেই।” ওই কর্তার মতে, “মনে হচ্ছে, শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের একাংশের সঙ্গে এই মর্মেই বোঝাপড়া হয়েছিল যে, প্রয়োজনের সময়ে গুলি ও বোমার সরবরাহে কোনও খামতি হবে না ও তার বিনিময়ে খাগড়াগড়ের ডেরায় নিশ্চিন্তে কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া যাবে।” আইবি-র সন্দেহ, বিস্ফোরণের ঘটনার অব্যবহিত পর পুলিশ ও দমকল ঢুকতে গেলে রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি গুলি করার যে হুমকি দিয়েছিল, সেই স্পর্ধা হয়েছিল স্থানীয় নেতাদের কয়েক জনের সঙ্গে বোঝাপড়া থেকেই।

সিপিএমের বিধায়ক ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ১৭ জন বাম বিধায়কের একটি দল এ দিন খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। আনিসুর রহমান বলেন, “এলাকায় এই ধরনের কার্যকলাপ চলছে আর সেটা শাসক দলের কেউ জানেন না, এটা হতে পারে না।” তবে খাগড়াগড় গ্রামের তৃণমূল সভাপতি ফিরোজ শেখের বক্তব্য, “জঙ্গি কার্যকলাপ তো দূরের কথা, জনবহুল এলাকায় কোনও খারাপ কাজ হচ্ছে, সেটা জানলে কি কেউ মেনে নেবে? তৃণমূলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে চক্রান্ত হচ্ছে।”

আইবি-র এক অফিসার অবশ্য জানান, নিয়মিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক এনে খাগড়াগড়ের ওই ডেরায় অস্ত্র ও গুলি-বারুদের গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছিল এবং সেখানে দেশি গ্রেনেডের মতো মারণাস্ত্র তৈরি করা হচ্ছিল, এমন তথ্য হয়তো ওই স্থানীয় নেতাদের কাছে ছিল না। তবে ওই কর্তার মতে, “গুলি তৈরি বা ছোটখাটো বোমা তৈরির বিষয়টিও ওই নেতারা জানতেন না, সেটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE