অ্যাপোলোর সামনে মৃত রত্না ঘোষের পরিবারের বিক্ষোভ।নিজস্ব চিত্র
মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আহত হুগলির যুবক সঞ্জয় রায়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনেগেলস হাসপাতালের ভূমিকায় প্রাথমিক ভাবে কিছু ফাঁক খুঁজে পেল স্বাস্থ্য দফতর। শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে এ কথাই জানিয়ে এসেছেন স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তারা। নবান্ন সূত্রের খবর, স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। একই ভাবে বর্ধমানের নবাবহাটের পিজি নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সে ক্ষেত্রেও আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
বেসরকারি হাসপাতালের কোনও অনিয়ম খুঁজে পেলে তা বরদাস্ত করা হবে না বলে বুধবার হাসপাতাল কর্তাদের ডেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তা যে কথার কথা নয়, বরং সরকার তা কাজে করে দেখাতে চলেছে— এ দিন স্বাস্থ্যকর্তাদের নবান্নে ডেকে সে কথা ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। বৈঠকে ছিলেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি। ঘটনাচক্রে এ দিনই অ্যাপোলো হাসপাতালের বিরুদ্ধে আর এক রোগীর চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। ওই রোগী, বর্ধমানের বাসিন্দা রত্না ঘোষ এ দিন সকালে মারা যান। হাসপাতালের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে তাঁর পরিবারের বক্তব্য, চিকিৎসার কাগজপত্রের সঙ্গে অন্য কোনও রোগীর ২০০১ সালের ইসিজি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে তাঁদের। হাসপাতালের পক্ষ থেকে অবশ্য গাফিলতির অভিযোগ মানা হয়নি।
অ্যাপোলো হাসপাতাল ও পিজি নার্সিংহোমের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এ দিন দুপুরে স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল-সহ স্বাস্থ্য দফতরের কয়েক জন প্রতিনিধিকে নবান্নে ডেকে পাঠানো হয়। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, সঞ্জয় রায়ের চিকিৎসার বিষয়ে অ্যাপোলোর দেওয়া ব্যাখ্যায় তাঁরা মোটেই সন্তুষ্ট নন। তাঁদের মনে হয়েছে, অনেক সরল পদ্ধতিতে ওই যুবকের চিকিৎসা করা যেত। তবু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাপোলোকে সঞ্জয়ের চিকিৎসা-সংক্রান্ত যাবতীয় রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে জমা দিতে বলা হয়েছে। দফতর সূত্রে খবর, একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটির সদস্যরা রিপোর্ট খতিয়ে দেখে যদি মনে করেন, অনাবশ্যক চিকিৎসার বিল বাড়ানো হয়েছিল, তা হলে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হবে। সঞ্জয়ের পরিবার যদি এফআইআর না-ও করেন, স্বাস্থ্য দফতর বা পুলিশই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর করবে। এ দিন, সঞ্জয়ের স্ত্রী রুবি এবং তাঁদের প্রতিবেশীরা তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে যান। পরে জানান, তাঁরা অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে চলেছেন।
সেই ১৬ বছরের পুরনো ইসিজি রিপোর্ট।নিজস্ব চিত্র
ঝাড়খণ্ডের শিকারি পাড়ায় নিহত তপন লেটের মেয়ে চুমকির চিকিৎসার বিষয়টি নিয়েও নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য দফতর। শুক্রবারই একাধিক চিকিৎসক বলেছিলেন, চুমকির যা রোগ হয়েছিল, তাতে তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রেফার করার কোনও কারণ ছিল না। রামপুরহাট হাসপাতালে যে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ চুমকিকে পরীক্ষা করেছিলেন, সেই দেবাশিস চক্রবর্তীকে এ দিন শো-কজ করা হয়েছে। তপন লেটের স্ত্রী অণিমা ওই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করবেন কি না, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তা সত্ত্বেও অন্য দিকে, এ দিনই পিজি নার্সিংহোমের তিন মালিক ও এক কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে জেলা পুলিশ। নার্সিংহোমটিকে শো-কজ করেছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায় বলেন, ‘‘এর আগেও আইন না-মানায় ওই নার্সিংহোমকে শো-কজ এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বার অভিযোগ ওঠায় নার্সিংহোম কেন বন্ধ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ফের শো-কজ করা হয়েছে।’’
চুমকির ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে। রামপুরহাট হাসপাতালের এক সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের চালকই চুমকিদের ভুল বুঝিয়ে পিজি নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। বিষয়টি সামনে আসতেই ওই ‘নিশ্চয় যান’টি সরিয়ে নিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
তবে শুধু অ্যাপোলো বা বর্ধমানের নার্সিংহোম নয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলির সব রকম অনিয়মের বিরুদ্ধেই যে সরকার কড়া হতে চলেছে, মুখ্যমন্ত্রী ফের সেই বার্তাই দিয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবনে অ্যাপোলোর কর্তাদের ডেকে যে ভাবে প্রায় জনসমক্ষে তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা, তাতেও এই মনোভাবের প্রতিফলন স্পষ্ট।
নবান্নের খবর, বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে নিয়মে বাঁধতে রেগুলেটরি কমিশন গঠনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ওই কমিশনে রোগীদের অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তির ওপরে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে। লাইসেন্স দেওয়া ও লাইসেন্সের নবীকরণের ক্ষেত্রে যাতে হাসপাতালগুলির কর্তারা সরকারি কর্মীদের প্রভাবিত করতে না পারেন, জোর দেওয়া হচ্ছে সে ক্ষেত্রেও।
আরও পড়ুন:মুখ্যমন্ত্রী মমতা রুষ্ট, ‘শরীর ভাল নেই, বুকে ব্যথা হচ্ছে’ মদন মিত্রের
৬০ বছরের রত্নাদেবী গত ১১ তারিখ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর হার্ট ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। এর পর চিকিৎসকরা জানান, অবিলম্বে পেসমেকার বসাতে হবে। সেটাও বসানো হয়। কিন্তু অসুস্থতা কমে না। এ দিন ভোরে মারা যান তিনি। হাসপাতালের বিল হয় আট লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা। রোগীর পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসায় বড় ধরনের গাফিলতি ঘটেছে। এমনকী, এ দিন যখন হার্ট অ্যাটাক হয়, সেই সময়েও বহু ক্ষণ তাঁর কোনও চিকিৎসাই হয়নি বলে অভিযোগ। এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘হাসপাতালের যথেচ্ছাচার আমরা প্রতি পদে টের পেয়েছি। ইসিজি-র যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, সেটা আসলে ২০০১ সালে কোনও এক রোগীর ইসিজি রিপোর্ট। তার ভিত্তিতেই রোগীর হার্টের অবস্থা খারাপ বলে দাবি করেছে হাসপাতাল।’’
হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার জয় বসু অবশ্য দাবি করেন, চিকিৎসায় গাফিলতি ছিল না। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সঙ্গেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও বাঁচানো যায়নি রত্নাদেবীকে। কারণ, তাঁর নানাবিধ শারীরিক সমস্যা ছিল। যদিও পুরনো ইসিজি রিপোর্ট কী ভাবে দেওয়া হল, তার কোনও ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। নবান্ন সূত্রে খবর, বর্তমান পরিস্থিতিতে অ্যাপোলোর কর্তারা সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, যদি ক্ষমা চাওয়ার থাকে, হাসপাতাল কর্তারা জনতার কাছে ক্ষমা চাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy