জরিনা বিবির কাছে সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার লাভপুরে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
বীরভূমের লাভপুরে সিপিএম সমর্থক তিনি ভাইকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় সিবিআই-তদন্ত কেন হবে না, রাজ্য সরকারের কাছে তার ব্যাখ্যা চাইল কলকাতা হাইকোর্ট। ১ অগস্টের মধ্যে এ ব্যাপারে হলফনামা পেশ করতে মঙ্গলবার সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। একই সঙ্গে বীরভূমের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের প্রতি আদালতের নির্দেশ: নিহতদের ঘরছাড়া পরিবার-পরিজনকে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে তাঁদের নিরাপত্তা।
খুন হওয়া তিন ভাইয়ের মা জরিনা বিবি হত্যাকাণ্ডের সিবিআই-তদন্ত চেয়ে বিচারপতি দত্তের আদালতে মামলা করেছেন, এ দিন যার শুনানি ছিল। আবেদনকারিণীর কৌঁসুলি সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন শুনানি শেষে আদালতের বাইরে দাবি করেন, জরিনা বিবিকে তো বটেই, তাঁর নিহত তিন ছেলের আত্মীয়-পরিজন থেকে শুরু করে জখম আর এক ভাই সানোয়ার শেখ লাভপুর-কাণ্ডের জেরে ঘরছাড়া প্রত্যেককে নিরাপত্তা জোগাতে পুলিশ-প্রশাসনকে আদেশ দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত। আদালতের নির্দেশ শুনেও জরিনা বিবি অবশ্য আশ্বস্ত হতে পারছেন না। অন্য দিকে বীরভূম জেলা প্রশাসন হাইকোর্টের নির্দেশ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায়।
জরিনা বিবির তিন ছেলে খুন হয়েছিলেন চার বছর আগে। অভিযোগ, ২০১০-এর ৩ জুন রাতে লাভপুর থানার নবগ্রাম লাগোয়া বুনিয়াপাড়ার বাড়ি থেকে তাঁর সিপিএম সমর্থক পাঁচ ছেলেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গ্রামের তদানীন্তন তৃণমূল নেতা মনিরুল ইসলামের বাড়িতে, সালিশি সভার নাম করে। সেখানে তিন ভাইকে পিটিয়ে মারা হয়। এক ভাইকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায় খুনিরা, আর এক ভাই পাঁচিল টপকে পালিয়ে বাঁচেন। পর দিন ওঁরা দু’জন মনিরুলের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। পুলিশ মনিরুলকে গ্রেফতারও করেছিল, কিন্তু ক’দিন বাদে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
সেই ইস্তক জরিনা বিবির গোটা পরিবার ভিটেছাড়া। ইতিমধ্যে ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে লাভপুরের বিধায়ক হয়েছেন মনিরুল ইসলাম। এবং লাভপুর-মামলায় ঘুরে-ফিরে উঠে আসছে তাঁর নাম ও তাঁর বিতর্কিত একটি বক্তৃতার প্রসঙ্গ। জরিনা বিবি এ দিন লাভপুরে এক ছেলের বাড়িতে বসে আক্ষেপ করেন, মনিরুলের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করার পরে পরিবারের কেউ নিজের গ্রামে ঢুকতে পারছেন না। “এর আগে অনেকেই নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আমরা ভিটেতে ফিরতে পারিনি। বিচারপতির নির্দেশের পরেও গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তিষ্ঠোতে পারব কি?” প্রশ্ন তাঁর। এমন সংশয় কেন? বৃদ্ধার উত্তর, “গ্রামের বেশির ভাগ লোক মনিরুলের সমর্থক। তাই গ্রামে গিয়ে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে কাটাতে হবে। বুঝতে পারছি না, কার ভরসায় ফিরব।”
জরিনা বিবির সংশয় নিরসনের মতো কোনও স্পষ্ট আশ্বাস এখনও জেলা কর্তৃপক্ষের তরফে মেলেনি। বীরভূম পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এ দিন বিকেলে জানিয়েছেন, তাঁরা এখনও আদালতের নির্দেশ হাতে পাননি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্য দিকে তিন ছেলের হত্যাকাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত চেয়ে মায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে বিচারপতি দত্ত এ দিন জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের হলফনামা জমা পড়লে সে সম্পর্কে আবেদনকারীর বক্তব্য ৬ অগস্ট হাইকোর্টে পেশ করতে হবে। মামলার পরবর্তী শুনানি ৭ অগস্ট।
এ দিন মামলায় কী হল?
এ দিন শুনানির শুরুতেই বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিতর্কিত ভাষণটির একটি লিখিত বয়ান কোর্ট অফিসার মারফত সরকারি কৌঁসুলি সম্রাট সেনের হাতে তুলে দেন বিচারপতি দত্ত। সরকারি কৌঁসুলিকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “ভাষণরত বিধায়কের ছবি সোমবার বিকেলে আপনাকে দেখানো হয়েছে। ওঁর সেই ভাষণের সঙ্গে লিখিত বয়ান মিলছে কি?” জবাব আসে, “যা দেখেছি, তা হুবহু মনে নেই। তবে বয়ানের একটা লাইন নিয়ে আমার আপত্তি রয়েছে।”
মনিরুলের ভাষণের লিখিত বয়ানের একটি লাইন উদ্ধৃত করে বিচারপতি দত্ত বলেন, “লেখা রয়েছে, মাইয়াটার উপর দিয়ে যারা অত্যাচার করেছিল, তাদের তিন জনকে পায়ের তল দিয়ে মেরে দিয়েছি।’’ লাভপুর-হত্যার তদন্তকারী অফিসার (আইও) তথা লাভপুর থানার ওসি দেবব্রত ঘোষের দিকে তাকিয়ে সরকারি কৌঁসুলির কাছে বিচারপতি জানতে চান, “আমি যদি আপনার পুলিশ অফিসারকে কয়েকটা প্রশ্ন করি, আপনার আপত্তি থাকবে?”
সরকারি কৌঁসুলির মন্তব্য, “প্রকাশ্য আদালতে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এটা গ্যালারি শো হয়ে যাবে।” এ কথা শুনে এজলাসে উপস্থিত বিভিন্ন আইনজীবী ও অন্যদের দিকে তাকিয়ে বিচারপতি দত্ত নির্দেশ দেন, “যাঁরা এই মামলার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁরা বাদে বাকিরা আদালত কক্ষ খালি করে দিন। মামলার শুনানি ইন-ক্যামেরা হবে।” রুদ্ধদ্বার শুনানিপর্ব শেষ হলে জরিনা বিবির কৌঁসুলি সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, তদন্তকারী অফিসারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারপতি তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। আইও তার উত্তর দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy