Advertisement
০৩ মে ২০২৪

জ্ঞান ফিরতেই দেখি হাসপাতালে

প্রাণ বাঁচাতে অন্যদের সঙ্গে তিনিও দৌড়ে ছিলেন মসজিদের দিকে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে লুটিয়ে পড়েন পাঁড়ুইয়ের সিরশিট্টা গ্রামের যুবক হোসেন আলি। অবশ্য বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন। গুলি তার ডান পায়ে লেগে সামান্য রক্ত ঝরিয়েছে। রবিবার দুপুরে সিউড়ি সদর হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে হোসেন দাবি করেন, “বোলপুর যাব বলে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কয়েক পা এগোতেই শুনি বিজেপি-র লোকেরা আমাদের গ্রাম ঘিরে নিয়েছে। যে কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে।”

সিউড়ি সদর হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হোসেন আলি। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

সিউড়ি সদর হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হোসেন আলি। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০০
Share: Save:

প্রাণ বাঁচাতে অন্যদের সঙ্গে তিনিও দৌড়ে ছিলেন মসজিদের দিকে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে লুটিয়ে পড়েন পাঁড়ুইয়ের সিরশিট্টা গ্রামের যুবক হোসেন আলি। অবশ্য বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন। গুলি তার ডান পায়ে লেগে সামান্য রক্ত ঝরিয়েছে।

রবিবার দুপুরে সিউড়ি সদর হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে হোসেন দাবি করেন, “বোলপুর যাব বলে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কয়েক পা এগোতেই শুনি বিজেপি-র লোকেরা আমাদের গ্রাম ঘিরে নিয়েছে। যে কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে।” আত্মরর্ক্ষার জন্য মসজিদের কাছাকাছি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ, জানতাম আর যাই হোক ওরা মসজিদে ঢুকবে না। আক্রমণকারীরা এলেই মসজিদে ঢুকে পড়ব। আমার সঙ্গে আরও পাঁচ-ছ’জনও ওই ভাবেই আত্মরক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন।” তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, সকাল সওয়া ৭টা নাগাদ হঠাত্‌-ই প্রায় দেড়-দু’শো লোক একসঙ্গে বোমা, লাঠি, ধারালো অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসে। প্রাণ ভয়ে সকলে তখন মসজিদের দিকে ছুট লাগান। হোসেন বলেন, “আমি বাকিদের থেকে পিছনে পড়ে যাই। ওরা মসজিদের ভিতর ঢুকে গেলেও আমি সেখানে ঢোকার মুখে ওদের ছোড়াগুলিতে লুটিয়ে পড়ি। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।”

হাসপাতালে পৌঁছনোর পরেই চিকিত্‌সকেরা হোসেনের ডান পায়ের হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালির উপর পর্যন্ত টান টান করে ব্যান্ডেজ বেধে দেন। পাশে বসে থাকা সর্ম্পকিত ভাই আরিফ আপেল কেটে দিচ্ছেন। সেটা খেতে খেতেই ওই যুবক জানান, তাঁর পরিবার তৃণমূল সমর্থক। বাড়িতে মা, বাবা ও তিন ভাই রয়েছে। একমাত্র দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দাদা একাদশ শ্রেণিতে ও ভাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। হোসেন আর তাঁর বাবা বোলপুরে থাকেন। রংমিস্ত্রির কাজ করেন। শনিবার সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরেছিলেন। কাজে যোগ দিতে এ দিন সকালেই বোলপুরে ফইরে যাচ্ছিলেন। তাঁর দাবি, “তিন জনকে গুলি ছুড়তে দেখেছি। তিন জনেই আমাদের সিরশিট্টার বাসিন্দা। প্রত্যেককেই আমি চিনি।” শুধু তাই নয়, এমনকী তিন জনের মধ্যে ঠিক কার ছোড়া গুলিতে জখম হয়েছেন, সেটাও হোসেন বুঝতে পেরেছেন বলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে দাবি করলেন। তাঁর কাকা রহমত শেখ বলছেন, “গুলি লাগার খবর পেয়েই আমরা হোসেনকে উদ্ধার করে ভটভটিতে চাপিয়ে প্রথমে অবিনাশপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসি। সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ সিউড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে চলে আসি।” সিউড়ি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য হোসেনের পায়ের অস্ত্রোপচার করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বলে রহমতের দাবি। তাই ভাইপোকে নিয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন।

তার কিছু ক্ষণ পরেই যুব তৃণমূলের সিউড়ি ২ ব্লক সভাপতি পবিত্র দাস সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, এই মাত্র হোসেনকে বর্ধমান মেডিক্যালে পাঠানো হল। তখনই পুলিশের একটি বড় ভ্যান এসে থামল হাসপাতালের মর্গের কাছে। ওই ভ্যানেই দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে নিহত বিজেপি কর্মী শেখ জসিমউদ্দিনের মৃতদেহ আনা হয়েছে। এ খবর আগেই ছিল। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সংবাদমাধ্যমকে আড়াল করতে পুলিশ কর্মীরা মৃতদেহটি নামাতে রীতিমতো গড়িমসি শুরু করে। বেগতিক দেখে পুলিশ ভ্যানটিকে একেবারে মর্গের গেটের মুখে নিয়ে গিয়ে দেহটি নামানো হল। তাতেও অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে আড়াল করা যায়নি। মেঝেতে রাখা মৃত জসিমের জামা দিয়েই তাঁর মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই অবশ্য তাঁর মুখ থেকে জামা সরিয়ে দেওয়া হয়।

এ দিকে, দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ জসিমের মৃতদেহ এসে পৌঁছয় সিউড়ি মর্গে। তবু এ দিন তার দেহ ময়না-তদন্ত করা যায়নি। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের গাফিলতিতিতেই তা হয়নি। বিকেল ৪টে ৫ মিনিট নাগাদ হাসপাতাল সুপারের অফিসের নীচে দাঁড়িয়ে এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা গেল, “আমাকে ময়না-তদন্তের জন্য এখানে পাঠিয়ে দিল। অথচ ময়না-তদন্ত করার কাগজপত্রই এখনও এসে পৌঁছল না!” তিনি আরও দাবি করেন, দুপুর ২টোর পরে তাঁকে মর্গে যাওয়ার কথা বলা হয়। তিনি সোয়া ৩টে নাগাদ মর্গে চলে আসেন। কিন্তু ময়না-তদন্তের প্রয়োজনীয় কাগজের ব্যাপারে তাঁকে নাকি কিছু বলা হয়নি। উল্টে ওই কথার মাঝেই সিউড়ি থানার এক এএসআই সেখানে এসে ওই পুলিশকর্মীর কাছেই জানতে চান, তিনি ময়না-তদন্তের কাগজপত্র এনেছেন কিনা। পুলিশকর্মী অবশ্য সাফ জানিয়ে দেন, তাঁকে কোনও কাগজ দেওয়া হয়নি। সে কথা শুনে ওই এএসআই ফিরে যান। বিকেল ৪টের পরেও ওই কাগজ হাসপাতালে এসে পৌঁছয়নি।

অন্য দিকে, রবিবার হলেও জেলা পুলিশ সুপারের অফিসের ডিআইবি-র দফতর খোলা ছিল। পুলিশের দু’টি গাড়িও সেখানে দাঁড়ইয়েছিল। ডিআই ওয়ান প্রবীরকুমার ঘোষ-সহ কয়েক জন অফিসার ও কর্মী সেখানে থাকলেও কেউ কোনও রকম মুখ খোলেননি। এরই মধ্যে এক ডিআইবি অফিসার চলে এলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ি নিয়ে তিনি বেরিয়ে যান পাড়ুইয়ের উদ্দেশ্যে। এটুকু ছাড়া এ দিন পুলিশ সুপারের অফিস ছিল কার্যত সুনসানই।

দূরে কোথাও যেন যুদ্ধ লেগেছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE