Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

ভট্টাচার্য পরিবারের দুই শরিকের পুজো যেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য

গ্রামের আটচালার বাড়িটির সংস্কারে ডাকা হয়েছিল স্থপতিকে। সেটাও প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। সেই বাড়ির পুজো নিয়ে বাড়তি কৌতূহল থাকাটাই স্বাভাবিক। শুধু পুজোর আকর্ষণ নয়, নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন মিলবে হাওড়ার আমতার নারিট গ্রামে।

পুজোর দালানে মিলেমিশে একাকার দুই শরিকের নবীন-প্রবীণ। ছবি: সুব্রত জানা।

পুজোর দালানে মিলেমিশে একাকার দুই শরিকের নবীন-প্রবীণ। ছবি: সুব্রত জানা।

নুরুল আবসার
নারিট শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৪৬
Share: Save:

গ্রামের আটচালার বাড়িটির সংস্কারে ডাকা হয়েছিল স্থপতিকে। সেটাও প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। সেই বাড়ির পুজো নিয়ে বাড়তি কৌতূহল থাকাটাই স্বাভাবিক। শুধু পুজোর আকর্ষণ নয়, নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন মিলবে হাওড়ার আমতার নারিট গ্রামে। গ্রামে ভট্টাচার্য পরিবারের দুই শরিকের দুটি দুর্গাপুজো। গ্রামবাসীর কাছে যা বড় বাড়ি, ছোট বাড়ির পুজো হিসাবেই খ্যাত।

দুই পরিবারেরই রয়েছে আলাদা দুর্গা দালান। দুটি আটচালা। সরু ইটের গাঁথনির দুটি পুরনো বিশাল বাড়ির মধ্যে নজর কাড়ে ছোট বাড়ির আটচালাটি। যা গ্রামবাংলায় সচরাচর দেখা যায় না। দেওয়ালের খোদাই বলে দেবে, এটি সংস্কার করা হয়েছিল ১৯০৭ সালে এবি অ্যান্ড এমবি নামে একটি সংস্থার পরিচালনায়। দুটি বাড়ি জুড়েই প্রাচীন স্থাপত্যের একাধির নজির। বংশের আদিপুরুষদের মধ্যেও নক্ষত্র সমাবেশ। এই বংশের সন্তান ছিলেন মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন। বিদ্যাসাগর অবসর নেওয়ার পরে যিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যও এই বংশের সন্তান। এঁদের সঙ্গে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দিকপালদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তার বহু নিদর্শন সাক্ষ্য হিসাবে দেখা যাবে দুই বাড়িতেই।

প্রায় ৩০০ বছর আগে এই পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। কয়েক বছর পরে একান্নবর্তী পরিবার দু’ভাগ হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় পুজোও। কেন পরিবারে ভাঙন ধরেছিল, বংশের কোনও উত্তরপুরুষ তার কারণ বলতে পারলেন না। তবে সাধ্যমতো জাঁকের সঙ্গেই যে তাঁরা পুজোর আয়োজন করেন তাও জানাতে ভোলেননি। দুই পরিবারের পুজোর প্রতিমার গঠনও হবহু এক। সাধারণ মতে দুর্গার ডানদিকে অবস্থান গণেশ ও লক্ষীর। বাঁ দিকে থাকেন সরস্বতী ও কার্তিক। কিন্তু এই দুটি পরিবারে দুর্গার বাঁ দিকে থাকেন গণেশ ও সরস্বতী। ডান দিকে কার্তিক ও লক্ষ্মী। কলা বৌ গণেশের পাশে নন, থাকেন কার্তিকের পাশে। তবে পুজোর নিয়ম আলাদা দুই পরিবারের। ছোট বাড়ির পুজো হয় দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা মতে। বড় বাড়ির পুজো হয় কালিকাপূরাণ মতে।

ছোট বাড়ির পুজোয় এক সময় ছাগ বলি হলেও বর্তমানে তা বন্ধ। বড় বাড়িতে নবমীর রাতে ছাগ বলির প্রথা আজও পালন হয়। ছোট বাড়িতে দুর্গাপুজোর পরে একই মণ্ডপে অধিষ্ঠিত হন দেবী লক্ষ্মী। বড় বাড়িতে লক্ষ্ণীপুজো হয় না। দুই পুজোর আচার-উপচারে এমন বৈপরীত্যের পাশাপাশি দুই বাড়ির মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে মোটা ইটের পাঁচিল।

যদিও দুই বাড়িরই বর্তমান প্রজন্মেবর কাছে এই ব্যবধান কোনও গুরুত্বই পায়নি। আর তাই ছোট তরফের স্নাতক কন্যা মনামী ভট্টাচার্য অনায়াসে আড্ডা মারতে চলে আসেন বড় বাড়ির দুর্গা দালানে। বড় তরফের বছর আঠাশের তরুণ পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার চন্দন ভট্টাচার্য ঢাক বাজাতে চলে আসেন ছোট বাড়ির পুজোয়। ছোট তরফের বছর ৬৬-র মোহন ভট্টাচার্যর আবার দুই বাড়ির পুজোতেই ঢাক না বাজালে ঘুমোতে পারেন না।

দুই বাড়ির এমন আদানপ্রদানে তাহলে ইটের পাঁচিল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে কেন? প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই দুই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে উত্তর ভেসে এল, ‘‘আমরা নিজেরাই সেই বাধা ঘোচাতে চাইনি।’’

কিন্তু কেন?

এ বার মোহনবাবু, চন্দন ও মনামীর সহাস্য উত্তর, ‘‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, বুঝলেন না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga puja Traditional puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE