নির্মাণ: রূপনারায়ণের চরে মাথা তুলছে হোটেল। ছবি: সুব্রত জানা। ডানদিকে, চর জেগেছে নদের। নিজস্ব চিত্র
নদী দূষণ বরদাস্ত করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। অথচ, সেই হুঁশিয়ারিকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাগনান-২ ব্লকের ওড়ফুলিতে রূপনারায়ণের চরে রমরমিয়ে চলা দু’টি হোটেলের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ওই নদে। আরও দু’টি বড় হোটেলের নির্মাণকাজ চলছে।
ওই নদ সংস্কারের দাবিতে বাগনানের বাকসি থেকে গাদিয়াড়া পর্যন্ত পদযাত্রা শুরু করেছে ‘রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’। মঙ্গলবার শুরু হওয়া ওই পদযাত্রা বুধবার পৌঁছয় ওড়ফুলিতে। কমিটির কাছে গ্রামবাসীরা চরে যে ভাবে হোটেল তৈরি হচ্ছে এবং নদে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানান। কমিটির সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রত্যুষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই চর কৃষকদের চাষের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া যেত। ভাঙনের জেরে যাঁরা ভিটেমাটি হারিয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া যেত। তার বদলে নদীর বুকে হোটেল চলছে, এটা ভাবা যায় না।’’ কী ভাবে চরে হোটেল গড়ে উঠল, তার তদন্তের দাবিও করেছে কমিটি।
বিডিও সুমন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এটা কী ভাবে হয়? আমি সেচ দফতরের সঙ্গে কথা বলব।’’ সেচ দফতরের হাওড়া ডিভিশনের পক্ষে রূপনারায়ণ দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাস্তুকার রঘুনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বছর চারেক আগে প্রথম যে হোটেলটি তৈরি হয়েছিল তখন আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, তাঁরাই জমির মালিক। বাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দাখিল করেন। ফলে, আমরা পিছিয়ে আসি। তবে, বাকি হোটেলগুলি কী ভাবে হচ্ছে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমরা খতিয়ে দেখব। যদি দেখা যায়, সেচ দফতরের জমিতে হয়েছে, তা হলে কড়া ব্যবস্থা নেব।’’
‘রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’র প্রশ্ন, নদীর চরের জমি যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়েও থাকে, তার চরিত্র বদল অর্থাৎ বাস্তুজমিতে পরিণত করে তবেই হোটেল তৈরির প্রয়োজনীয় অনুমতি নেওয়া যায়। নদীর চর কী ভাবে বাস্তুতে পরিণত হল? পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতই বা কিসের ভিত্তিতে পাকা নির্মাণকাজের অনুমতি দিল? প্রতিটি বিষয়ের খোঁজ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিডিও। তবে, হোটেলগুলির তরফে কেউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কোলাঘাট রেলসেতু পেরিয়ে রূপনারায়ণের বাঁধ ধরে দক্ষিণ দিকে মাইলখানেক গেলেই ওই সব হোটেলের দেখা মেলে। এই এলাকায় বছর পঁচিশ আগে রূপনারায়ণে চর পড়ে। চরের কিছুটা অংশে খড়িবন। বাকি অংশে হোটেল তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। যে দু’টি হোটেল তৈরি হয়েছে, সেখানে বর্জ্য ফেলার আলাদা ব্যবস্থা করা হলেও বেশির ভাগই পড়ছে নদীতে। আর যে দু’টি হোটেলের নির্মাণকাজ চলছে সেখানে চরের নিচু অংশ বোজাতে ট্রাকে করে আনা হচ্ছে বালি ও ছাই। জায়গা বাড়াতে একটি নির্মীয়মাণ হোটেল কর্তৃপক্ষ আবার চর সংলগ্ন রূপনারায়ণের কিছুটা বুজিয়ে ফেলেছে বলেও অভিযোগ।
সম্প্রতি জাতীয় পরিবেশ আদালত হাওড়া জেলা প্রশাসনকে নদী সংলগ্ন পঞ্চায়েতগুলিতে অবিলম্বে কঠিন বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে। নদীতে প্লাস্টিক ফেললে জরিমানার নিদানও দেওয়া হয়েছে। এরপরেও কী ভাবে রূপনারায়ণের চরে রমরমিয়ে হোটেল চলে এবং তার বর্জ্য নদে ফেলা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যাঁদের অধিকাংশই রূপনারায়ণের ভাঙনের জেরে ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধের ধারে বাস করছেন। হোটেলগুলির জন্য তাঁরা বিপাকে পড়েছেন বলে গ্রামবাসীর দাবি। তাঁদের বক্তব্য, চরের ঘাটে তাঁরা স্নান করতেন। বাড়িতে ব্যবহারের জলও তুলে আনতেন। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হোটেলগুলির জন্য সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
প্রজাপতি মাইতি নামে এক গৃহবধূ বলেন, ‘‘যাঁরা হোটেল করেছেন, তাঁরা নদী ব্যবহার করতে দেন না। রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জলের জন্য পাড়ার কারও পুকুরে যেতে হচ্ছে অনুমতি নিয়ে। একটি মাত্র ট্যাপকল আছে। কিন্তু তাতে দিনে একবার মাত্র জল আসে। জলের জন্য রূপনারায়ণই বড় ভরসা ছিল।’’ শ্রীকান্ত সামন্ত নামে আর একজন গ্রামবাসী বলেন, ‘‘রূপনারায়ণ আমাদের বাড়ি, জমি কেড়ে নিয়েছে। তবুও নদীর জল অন্তত ব্যবহার করতে পারতাম। এখন তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy