ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁ। ইংরেজিতে গালভরা নাম। খদ্দেরকে অভ্যর্থনা জানাতে বাইরে হাজির দরোয়ান। বাতানুকূল রেস্তরাঁয় সিসিটিভি-র নজরদারি। ভাত-ডালের পাশাপাশি চিকেনের জিভে জল আনা হরেক পদ।
এ হেন রেস্তরাঁর রান্নাঘরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ শ্রীরামপুর পুরসভার কর্তা-ব্যক্তিদের। ফ্রিজ খুলতেই দেখা গেল, গোটা চারেক প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ-ভর্তি বাসি ভাত। ফ্রিজার থেকে মাংস বের করেও আৎকে ওঠার জোগাড়! স্যানিটারি ইনস্পেক্টর বলেই ফেললেন, ‘‘বেশ কয়েক দিনের বাসি মনে হচ্ছে।’’ বিস্ময়ের তখনও বাকি। রান্নাঘর লাগোয়া শৌচাগার। দরজা খোলা। শৌচাগারের দরজার সামনেই এক দিকে প্লাস্টিকের গামলা ভর্তি ভাত। অন্য দিকে ডিম। এর পরে আবিষ্কার করা গেল মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যাকেট ভর্তি দুধ। সযত্নে ফ্রিজবন্দি।
এত বড় রেস্তরাঁ, তার লাইসেন্স কোথায়? বারবার চাওয়ার পরও অবশ্য তা দেখাতে পারলেন না ম্যানেজার। স্থানীয় মানুষজন এবং ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ, রান্নাঘরের গ্যাস বা ধোঁয়া বেরনোর পদ্ধতি ঠিক নেই। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই।
ভাগাড়ের মরা মাংস নিয়ে তটস্থ নবান্ন। বিভিন্ন জায়গায় রেস্তরাঁয় মাংসের মান পরীক্ষা করছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। বুধবার তেমনই অভিযান চলে শ্রীরামপুর শহরের অভিজাত এলাকা নেতাজি সুভাষ অ্যাভেনিউয়ের কয়েকটি রেস্তোরাঁয়। আর সেখানেই সামনে এল এমন গা ঘিনঘিন করা দৃশ্য। জেলা প্রশাসনের যে এ ব্যাপারে কোনও নজর নেই, তারও হাতেগরম প্রমাণ মিলল পুরসভার ঘণ্টাখানেকের অভিযানে।
ফ্রিজার থেকে বেরলো এমন পচা মাংস। নিজস্ব চিত্র
পুরসভার হিসেব বলছে, শ্রীরামপুর শহরে ছোট-বড় শতাধিক হোটেল-রেস্তরাঁ রয়েছে। দুপুরে ভাত-মাংস যেমন পাওয়া যায়, তেমনই চিকেন রেজালা, মটন কোর্মা, চিকেন বার্বি কিউ, কাটলেট— কি নেই খাদ্য-তালিকায়! সন্ধ্যায় বাতানুকুল রেস্তরাঁর নরম আলোয় ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন বা মটন বিরিয়ানি-চিকেন চাপে কামড় বসাতে তরুণ-তরুণী থেকে মাঝবয়সী দম্পতি সবাই আসেন। পকেটের রেস্ত অনুয়ায়ী রেস্তরাঁ বাছাই হয়। কিন্তু তাঁরা কি আদৌ জানেন কেমন খাবার পরিবেশন করা হয়?
পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় মানছেন, ভাগাড়-কাণ্ডের পরেই এমন তোড়জোড়। না হলে খাবারের মান যাচাইয়ে অভিযানের পরিকাঠামো পুরসভার নেই। পুরসভার নিজস্ব ফুড-ইনস্পেক্টরও নেই।
সকাল ১১টা নাগাদ ধোবিঘাট সংলগ্ন একটি রেস্তরাঁ থেকে শুরু হয় অভিযান। দেএকটি নামজাদা রেস্তোরাঁর ফ্রিজার থেকে বেরিয়ে আসে প্লাস্টিকের প্যাকেটে জমানো মাংস, চিংড়ি। পুরপ্রধান থেকে শুরু করে স্যানিটারি ইনস্পেক্টর অনুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল উত্তম রায়, সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়, কাউন্সিলর সন্তোষ সিংহরা পরখ করে জানান, বেশ কয়েক দিন ওই মাংস জমিয়ে রাখা হয়েছে। পচন ধরেছে কয়েকটিতে। একই ফ্রিজারে রাখা ‘গ্রেভি’।
রেস্তরাঁর মালিক প্রতিবাদ করে জানান, ঠিক পদ্ধতিতেই মাংস রাখা হয়। পরে দেখা যায়, দুধের প্যাকেটের মেয়াদ দিন চারেক আগেই শেষ হয়েছে। মালিক জানান, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। ফ্রিজারটি সিল করে দেওয়া হয় পুরসভার তরফে। সেখান থেকে একটু এগিয়ে একটি রেস্তরাঁয় গিয়েও বাসি খাবার, পচা মাংসের সন্ধান মিলল রান্নাঘরে। রেস্তরাঁর মালিক বা ম্যানেজার কাউকেই অবশ্য পাওয়া গেল না।
এর পরে প্রায় ৩৮ বছর পুরনো একটি রেস্তরাঁর রান্নাঘরে ঢুকে সন্তুষ্ট হন পুরসভার কর্তারা। সেখানে বড় রান্নাঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন। মাংস বা অন্য কোনও বাসি খাবার মেলেনি। বিভিন্ন রেস্তরাঁর মালিক বলেন, ফ্রিজার ব্যবহার করতেই হয়। অবশ্য পুরসভার তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাসি মাংস রাখা চলবে না।
পুরপ্রধান বলেন, ‘‘অন্তত চার-পাঁচটি রেস্তরাঁর মাংস দেখে বোঝা গেল, সংরক্ষণ ঠিক ভাবে হয় না। মাংসের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে।’’ আজ, বৃহস্পতিবার কাগজ নিয়ে সবাইকে পুরসভায় দেখা করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে পুরসভা কড়া ব্যবস্থাই নেবে।’’ এমন অভিযান চলবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
মঙ্গলবার তারকেশ্বর এবং কোন্নগরের বিভিন্ন হোটেলে অভিযান চালান সংশ্লিষ্ট পুর-কর্তৃপক্ষ। রান্না করা পদও পরখ করা হয়। কয়েকটি দোকানের ফ্রিজারে রাখা মাংসের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়।
এত দিন কোনও পক্ষের নজরই যে রেস্তরাঁর রান্নাঘর পর্যন্ত যাচ্ছিল না, তা অবশ্য পরিষ্কার। এখন পুরসভা কী ব্যবস্থা নেয়, প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy