Advertisement
E-Paper

উচ্চ মাধ্যমিকের মূল স্রোতেও নজর কাড়ছে মুসলিমরা

রৌশনারা ইসলাম এ বার উলুবে়ড়িয়ার নোনা হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ৪৬৫ নম্বর পেয়েছে। রঘুদেববাটি সাধারণের বিদ্যালয়ের ছাত্র রামিজ আহমেদ সর্দার পেয়েছে ৪৪২।

উলুবেরিয়া

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৬ ০৩:৪৭

রৌশনারা ইসলাম এ বার উলুবে়ড়িয়ার নোনা হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ৪৬৫ নম্বর পেয়েছে।

রঘুদেববাটি সাধারণের বিদ্যালয়ের ছাত্র রামিজ আহমেদ সর্দার পেয়েছে ৪৪২।

জগৎপুর কল্যাণব্রত সঙ্ঘ হাইস্কুলের সাবেরা খাতুনের প্রাপ্ত নম্বর ৪৬৮।

এরা কোনও হাইমাদ্রাসা বা সংখ্যালঘু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত মিশনের ছাত্রছাত্রী নয়। হাওড়া জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাধারণ হাইস্কুলগুলির পড়ুয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ফলাফলে দেখা গিয়েছে, এরা শুধু উত্তীর্ণ হওয়াই নয়, নিজের নিজের স্কুলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। তবে, শুধু হাওড়া জেলাই নয়, গত কয়েক বছরের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলে দেখা যাচ্ছে, গোটা রাজ্যেই শিক্ষার মূল স্রোতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা নজর কাড়ছে। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব নিজেদের বলে দাবি করেছে বামেরা। পাল্টা একই দাবি করেছে রাজ্যের শাসক দলও।

মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দু’টি সাবেক ধারা আছে। একটি হাইমাদ্রাসা-নির্ভর। অন্যটি মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত বিভিন্ন মিশনের। হাইমাদ্রাসায় সাধারণত তারাই ভর্তি হয়, যারা সাধারণ হাইস্কুলগুলিতে ভর্তি হতে পারে না। হাইমাদ্রাসাগুলির জন্য আলাদা বোর্ড আছে। দশম শ্রেণির পরীক্ষার পরে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সমতুল সার্টিফিকেট তাদের দিয়ে থাকে মাদ্রাসা বোর্ড। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাদ্রাসাগুলিতে পড়ানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে, মাদ্রাসা বোর্ড-পরিচালিত দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ছাত্রছাত্রীদের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হয় সাধারণ কোনও হাইস্কুলে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই মনে করেন, একটা ছোট্ট পরিসর থেকে এসে বড় প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে অনেকেই মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষার সাফল্য ধরে রাখতে পারে না। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। তবে, হাইমাদ্রাসাগুলির সিলেবাসের মধ্যে সিংহভাগ বিষয়ই হল ধর্ম বহির্ভূত। সেই কারণে, মুসলিম সমাজের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের প্রাথমিক লগ্নে হাইমাদ্রাসাগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করেননি শিক্ষাব্রতীরা।

মিশনগুলি নিজের মতো করে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেয়। রাজ্যের নানা প্রান্তের সেরা ছাত্রদের বেছে নিয়ে পড়াশোনা করায়। তবে, মিশনগুলির নিজেদের কোনও মাদ্রাসা বোর্ড বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্বীকৃতি না থাকায় পরীক্ষা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয় অন্য স্কুলের মাধ্যমে। ফলও বেশ ভাল হয়। মুষ্টিমেয় কিছু দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কম খরচ বা নিখরচায় মিশনে পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকলেও বাকিদের ক্ষেত্রে এখানে পড়াশোনা করা বেশ ব্যয়বহুল।

ভাল ফল এবং মিশনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রৌশনারা, রামিজ, সাবেরারা কিন্তু বেছে নিয়েছে শিক্ষার মূল স্রোতটিকে। এবং নিজেদের কৃতিত্ব প্রমাণ করেছে। সাবেরার কথাই ধরা যাক। সে উলুবেড়িয়ার জগৎপুর কল্যাণব্রত সংঘ হাইস্কুলে সে পঞ্চম শ্রেণি থেকে পড়ত। তার বাবা পেশায় জরির কারিগর। সাবেরার কথায়, ‘‘আমাকে অনেকে বলেছিল, কোনও মিশনে ভর্তি হয়ে যেতে। কিন্তু স্কুল ছাড়তে আমার মন চায়নি। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে পড়াশোনা করেছি। মূল স্রোতে থেকে সেরা হওয়ার আনন্দই আলাদা।’’

একই কথা জানায় উলুবেড়িয়া হাইস্কুলের ছাত্র মামন। তার বাবা শেখ হাসিবুর রহমান স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী। মামন বলে, ‘‘আমি পঞ্চম শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ছি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্কুলের সেরা হব ভাবিনি।’’ পাঁচলার গঙ্গাধরপুর বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক শঙ্কর খাঁড়ার কথায়, ‘‘আমাদের স্কুলে কোনও মুসলিম ছাত্রছাত্রী হয়তো প্রথম হয়নি। কিন্তু প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ১০ জন। এই সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে।’’ একই প্রবণতা দেখা গিয়েছে অন্য স্কুলেও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির করঞ্জলি বি কে ইনস্টিটিউশনের ছাত্র সিরাজুল হক সাউ বা মথুরাপুর আর্য বিদ্যাপীঠের শাবানা খাতুনরা তাদের নিজের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সেরা হয়েছে।

মূল স্রোতের পড়াশোনায় মুসলিম ছেলেমেয়েদের এই আগ্রহকে ‘শিক্ষা বিপ্লব’ করে দাবি করেছেন শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার। তাঁর কথায়, ‘‘গোড়ার দিকে মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারে হাই মাদ্রাসা বা মিশনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মূল স্রোতের শিক্ষায় আসার জন্য সমাজের একটা বৃহত্তর অংশ যে কতটা আকুল তার প্রমাণ মেলে হাইস্কুলগুলির এই ফলাফলে। সুযোগ পাওয়া গেলে ওই ছেলেমেয়েরাও যে কৃতী হতে পারে, এটা তারও প্রমাণ।’’

বামফ্রন্ট আমলের মাদ্রাসা শিক্ষামন্ত্রী আব্দুস সাত্তার মনে করেন, এটাই মুসলিমদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিণতি ছিল। তাঁর দাবি, ‘‘এর সিংহভাগ কৃতিত্বই পূর্বতন বাম সরকারের। ভূমি সংস্কার, মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন এবং পঞ্চায়েতরাজ জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে মুসলমানদের একটা বড় অংশকে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাইমাদ্রাসাগুলি গড়ে দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত। মিশনগুলির কৃতী ছাত্রেরা স্বপ্ন দেখিয়েছে। সে সবেরই যৌথ ফল শিক্ষার মূল স্রোতে মুসলিমদের ভিড়। শিক্ষাজগতে মুসলিমদের এই উত্তরণ সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর।’’

পক্ষান্তরে, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাম আমলে সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা খাতায়-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের সরকার তার সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। মানুষের রোজগার বেড়েছে। সাইকেল বিলি, কন্যাশ্রী, বিভিন্ন ধরনের ছাত্রবৃত্তি প্রকল্পে ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হয়েছে। ফলে, শিক্ষার মূল স্রোতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা বেশি করে আসছে।’’

Muslim HS
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy