Advertisement
E-Paper

ক্ষীণকায় দামোদর মনে পড়িয়ে দেয় আমতার অর্থনীতির সুদিনের স্মৃতি

কলকাতা ছাড়ালেই হাওড়ায় দামোদরের পূর্ব তীরে ছবির মতো জনপদ আমতা। কলকাতার মতো এ শহরের পত্তনের কোনও ইতিহাস নেই। তবে নানা ঐতিহ্যে পুষ্ট এবং একইসঙ্গে জর্জরিত সমস্যার যাঁতাকলে। তাই ঐতিহ্যের সুখস্বপ্নে ডুব দিয়ে শুধু বিভোর হয়ে থাকা নয়, নানা সমস্যা থেকেও মুক্তির আশায় এই শহরের মানুষ।

নুরুল আবসার

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০২
বেতাই বন্দর। এখন যে চেহারায়।

বেতাই বন্দর। এখন যে চেহারায়।

কলকাতা ছাড়ালেই হাওড়ায় দামোদরের পূর্ব তীরে ছবির মতো জনপদ আমতা। কলকাতার মতো এ শহরের পত্তনের কোনও ইতিহাস নেই। তবে নানা ঐতিহ্যে পুষ্ট এবং একইসঙ্গে জর্জরিত সমস্যার যাঁতাকলে। তাই ঐতিহ্যের সুখস্বপ্নে ডুব দিয়ে শুধু বিভোর হয়ে থাকা নয়, নানা সমস্যা থেকেও মুক্তির আশায় এই শহরের মানুষ।

হাওড়া জেলা জুড়ে যে বিশাল গ্রামীণ এলাকা রয়েছে, তার মধ্যে ইংরেজদের সময় থেকে আমতাকেই একমাত্র শহর বলে গণ্য করা হত। এই শহরে ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রামসদয় কলেজ জেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পীতাম্বর হাইস্কুল গড়ে ওঠে ১৮৫৭ সালে। শহরের প্রাচীন মেলাইচণ্ডী মন্দির অনেক কিংবদন্তির সাক্ষ্য দেয়। বেতাইয়ে ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। অবশ্য শুধু এ সবই নয়, শহর গড়ে ওঠার যে দু’টি প্রধান শর্ত থাকা প্রয়োজন সেই রেল ও জলপথ যোগাযোগের যুগলবন্দি একমাত্র আমতাতেই ছিল। যে রেলপথ চালু হয়েছিল স্যার বীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পদ্যোগীর হাত ধরে। হাওড়া থেকে আমতার মধ্যে ছোট লাইনের সেই ট্রেন পরিচিত ছিল মার্টিন রেল নামে। শুধু আমতা নয়, হাওড়াবাসীর কাছে এই ট্রেন ছিল আপনজনের মতো। কারও বাড়ির উঠোন, কারও বাগানের ভিতর দিয়ে ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যেত সেই রেলগাড়ি। মজার এই রেলগাড়ি নিয়ে অনেক গল্পও চালু রয়েছে। যার একটি হল, আত্মঘাতী হওয়ার জন্য কেউ এই রেলপথে শুয়ে পড়লে চালক ট্রেন থামিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায় মার্টিন রেল। তিরিশ বছর পরে ২০০০ সালের গোড়ায় সেই আমতায় চালু হল হাওড়া-আমতা ইএমইউ লোকাল ট্রেন। ঝাঁ চকচকে আমতা স্টেশন চত্বর আধুনিক জীবনের পরিচয় দিলেও, আজও এলাকার প্রবীণদের স্মৃতিমেদুর করে তোলে আমতা বাসস্ট্যান্ডের কাছে মার্টিন রেলের সেই পুরনো স্টেশন। মনে উঁকি মারে সেই ট্রেনকে ঘিরে নানা ঘটনার স্মৃতি।

এখন হরিশদাদপুর স্টেশন। ইনসেটে, পুকুরে পড়ে পুরনো স্টেশনের ফলক।

শহরের বুক চিরে রয়ে গিয়েছে দামোদর। যার একদিকে আমতা শহর, অন্য পারে বেতাই। পুরো এলাকা পরিচিত ছিল বন্দর নামে। এখন সেই দামোদর নেই, উধাও হয়েছে বন্দরও। নদী মজে এখানে সংকীর্ণ। নদীর বুক থেকে নিত্য বালি তোলা আর তা পাড়ে আনার জন্য কিছু ছিপ নৌকার চলাচল দেখে বোঝাই যাবে না এক সময় কী জমজমাট ছিল এই এলাকা। যদিও এলাকার পুরনো দিনের মানুষগুলির আজও থেকে গিয়েছে বন্দর নাম। স্থানীয় ব্যবসায়ী ষাটোর্ধ্ব শিবরাম চন্দ্র বললেন, “দেখেছি কলকাতা থেকে নদীপথে নানা জিনিসপত্র এসে এখানে নামত। তারপরে তা সড়কপথে ছড়িয়ে পড়ত উদয়নারায়ণপুর, জয়পুর, বাগনান প্রভৃতি এলাকায়।’’ এলাকার বহু মানুষ নৌ-পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশও ঘটেছিল নৌ-পরিবহণ ব্যবসার হাত ধরে। স্থানীয় বাসিন্দা দুধকুমার বাচিক জানালেন, “আমাদের একটা বড় নৌকা ছিল। সেটির মালিক ছিলেন আমার দাদু। ছোট বেলায় দেখেছি সেই নৌকা রাখা ছিল আমাদের বাড়িতেই। কী তার বহর! ক্রমে নদী মজে গেল, শেষ হয়ে বন্দরের সুদিন। নৌকা হয়ে গেল জ্বালানি।’’ তবে যুগের পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন দুধকুমারবাবুরা। পারিবারিক নৌ-পরিবহণের ব্যবসা ছেড়ে যুক্ত হয়েছেন লেদ কারখানার সঙ্গে। পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে আজও বন্দরের স্মৃতিচারণের সময় প্রচ্ছন্ন গর্বে চিকচিক করে ওঠে দুধকুমারবাবুর চোখ।

প্রাচীন মেলাইচণ্ডী মন্দির ।

শহর আমতা গড়ে উঠেছে আমতা এবং সিরাজবাটি এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে। স্থানীয় মানুষের দাবি, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতায় যাওয়ার পথে এখানে এসে নমাজ পড়েছিলেন। তাঁর নামেই এলাকার নাম হয় সিরাজবাটি। যদিও এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য তথ্য মেলেনি।

এক সময় আমতা শহর জুড়ে ছিল যাত্রার দল। দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে গোটা শীতকাল এমন কোনও পুজোপার্বণ বাদ ছিল না যেখানে যাত্রাদলের পালা হত না। রাত থেকে শুরু হত কনসার্ট, যার রেশ চলত সকালে রোদ উঠে যাওয়ার পরেও। এখন সেই সময় নেই। দুরন্ত গতিতে ছুটছে জীবন। তবুও এলাকার মানুষের মুখে আজও ফেরে মুরারি মজুমদার, বিজয় মজুমদার, গোবিন্দ মজুমদার, সত্য অধিকারীর মতো অ্যামেচার যাত্রাদলের সমস্ত দিকপাল শিল্পীর নাম। যুগের পরিবর্তন থাবা বসিয়েছে যাত্রা সংস্কৃতিতেও। নতুন প্রজন্ম আর যাত্রায় আগ্রহী নয়। সংস্কৃতি চর্চা এখন আবর্তিত হয় বসে আঁকো, নাচ-আবৃত্তি, সঙ্গীত প্রতিযোগিতায়।

(চলবে)

ছবি: সুব্রত জানা।

nurul absar amta amar sohor damodar river southbengal state news online news latest news online news latest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy