Advertisement
১৮ মে ২০২৪

পড়শিকে বাঁচাতে গিয়ে ছাত্র খুন চুঁচুড়ায়

অযাচিত ভাবে পাড়া-পড়শির সাহায্যে সে এগিয়ে যেত ছেলেবেলা থেকেই। আর সেটাই কাল হল। রবিবার রাতে পড়শি ‘কাকু’কে মারধরের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে খুন হয়ে গেল চুঁচুড়ার পিরতলার বড়ুয়াবাগান এলাকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুদেব দাস (১৭)। রাতেই পড়শিরা খুনে অভিযুক্ত তিন যুবককে ধরে পুলিশে দেন।

নিহত সুদেব দাস।

নিহত সুদেব দাস।

নিজস্ব সংবাদদাতা
চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৬
Share: Save:

অযাচিত ভাবে পাড়া-পড়শির সাহায্যে সে এগিয়ে যেত ছেলেবেলা থেকেই। আর সেটাই কাল হল।

রবিবার রাতে পড়শি ‘কাকু’কে মারধরের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে খুন হয়ে গেল চুঁচুড়ার পিরতলার বড়ুয়াবাগান এলাকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুদেব দাস (১৭)। রাতেই পড়শিরা খুনে অভিযুক্ত তিন যুবককে ধরে পুলিশে দেন।

যাঁকে বাঁচাতে গিয়ে সুদেব মারা যায়, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের আচরণ নিয়ে এলাকার লোকজনের আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল। দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাঁদের বিবাদের জেরেই এ দিনের ঘটনা বলে মনে করছেন এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ। গরিব, নিরীহ ছেলেটার মৃত্যুতে তাই পড়শিদের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে। রবিবার সকালে সুদেবের ওই পড়শির বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। ওই পড়শিও স্বীকার করেন, “আমার পরিবারে অশান্তি না থাকলে এ ঘটনা ঘটত না।” তাঁর দাবি, “গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সুদেবের গায়ে লাগে।” “ওকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। আমার জন্য ওকে মরতে হল। নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে।” বলেন তিনি।

সুদেবের বাবা স্বপন দাস রিকশা চালান। মা শোভাদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সুদেব ছোট। অভাবের সংসারে বাবাকে সাহায্যের জন্য পড়াশোনার ফাঁকে ছোটখাটো কাজও করত সুদেব। দিন কয়েক আগে স্বপনবাবুর পায়ে পেরেক ফুটে যাওয়ায় ক্ষত হয়। ফলে, রিকশা চালাতে পারছেন না তিনি। বিয়ের মরসুম হওয়ায় বিয়েবাড়ি ফুলে সাজানোর কাজ করছিল সুদেব। রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বাঁশবেড়িয়া থেকে সেই কাজ সেরেই ফিরছিল।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘কাকু’র বাড়ির সামনে পৌঁছতেই ভিতর থেকে চেঁচামেচি শুনে সুদেব এগিয়ে যায়। দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে সে দেখে ‘কাকু’কে তিন যুবক মারধর করছে। সুদেব বাধা দিয়ে যায়। তখনই এক যুবকের ছোড়া একটি গুলি তার পেটে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় সে লুটিয়ে পড়তেই তিন যুবক মোটরবাইকে উঠে মাঠ দিয়ে পালাতে থাকে। গুলির শব্দে আশপাশের লোকজন চলে আসেন। তাঁদের এক দল ওই যুবকদের ধাওয়া করেন। মোটরবাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যুবকেরা পড়ে গেলে এলাকার লোকজন তাদের ধরে ফেলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে চলে আসে টহলদার পুলিশ। সুদেবকে চুঁচুড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

কেন মারধর করা হচ্ছিল সুদেবের ওই পড়শিকে?

সুদেবের ‘কাকু’র দাবি, বছর দুয়েক আগে মেয়ের সঙ্গে মিল পল্লির সনু হরিজনের সম্পর্ক হয়েছিল। তিনি ওই সম্পর্ক মানেননি। মেয়েকে বারণও করেন। সেই মতো মেয়েও মাস দুয়েক আগে সনুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তা সত্ত্বেও, সনু যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছিল। রবিবার দুপুরেও বাড়িতে এলে সনুকে ফিরিয়ে দেন তিনি। সেই আক্রোশেই রাতে সে দুই সঙ্গীকে নিয়ে হামলা চালাতে আসে।

শোকার্ত মা ও পরিজনেরা।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) তথাগত বসু জানান, খুনে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে। ধৃত অভিজিৎ বসু, সনু হরিজন এবং টোটন মণ্ডলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। তিন জনেই মিলন পল্লি এলাকার বাসিন্দা। বাধা পেয়ে সনুই গুলি চালিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ধৃতদের সোমবার চুঁচুড়া আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাদের ৫ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আর যাঁকে বাঁচাতে গিয়ে সুদেবের প্রাণ গেল, সেই ব্যক্তি এবং তাঁর স্ত্রী-মেয়েকে আটক করা হয়েছে।

সোমবার সকাল হতেই স্থানীয় লোকজন সুদেবদের বাড়িতে ভিড় করেন। ছেলেটির মা শোভাদেবী কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। ঘন ঘন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। বাবা স্বপনবাবু বলেন, “আমার বেরোতে কষ্ট হচ্ছে দেখে ছেলে কাজে বেরোচ্ছিল। কিন্তু ও যে আর বাড়ি ফিরবে না, তা ভাবতে পারছি না।”

বিদ্যুতের বিল জমা দেওয়া থেকে রেশন এনে দেওয়া, রিকশা ডেকে দেওয়া, অসুস্থকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পাড়ার লোকজনের নানা দরকারে এগিয়ে যেত যে ছেলেটি, সে আর নেই এটা এলাকাবাসী বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁদের মধ্যে পুতুল দত্ত বলেন, “দরকার হলেই সুদেবকে ডাকতাম। আর পাব না!” অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথ জানান, ক’দিন আগে তিনি বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে বেরোচ্ছিলেন। দেখতে পেয়ে সুদেব সেই বিল নিজে গিয়ে জমা দিয়ে এসেছে। সুদেবের এমন নানা সাহায্যের কথা এ দিন অনেকেরই মুখে মুখে ফিরেছে।

একই ভাবে ভেঙে পড়েছেন চুঁচুড়ার মল্লিকবাটি পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু পালও। ওই স্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল সুদেবের। সুখেন্দুবাবু বলেন, “ছেলেটা শুধু পড়াশোনায় ভাল ছিল না, খুব পরোপকারীও ছিল। আপদে-বিপদে ডাকলে পাওয়া যেত। ওর চলে যাওয়া সমাজের ক্ষতি।”

ভেঙে পড়েছে সুদেবের সহপাঠীরাও।

ছবি: তাপস ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE