হোটেলের সংখ্যা ১৫০। লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ১২টির!
হাওড়ায় হোটেল-কাণ্ডের পরে অনুসন্ধান চালিয়ে পুরসভার হাতে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠেছে, পুরসভা ও পুলিশের নাকের ডগায় বছরের পর বছর কী ভাবে এই সব হোটেল ও লজ বেআইনি ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, হাওড়ায় হোটেল-ব্যবসা চালাতে হলে পুলিশ ও পুরকর্তাদের নানা ভাবে ‘ইনাম’ দিতে হয়। আর তার সুবাদেই লাইসেন্স নবীকরণ না করা অথবা অসামাজিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সাহস পান এক শ্রেণির হোটেল ব্যবসায়ী।
হাওড়ার একটি বেসরকারি হোটেলের মালিক সুমিত নাহার মৃত্যু হয় রবিবার। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের দুই স্থানীয় নেতার নামে মামলা হয়েছে। এ নিয়ে হইচই শুরু হতেই নড়েচড়ে বসেছে দুই স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারা। সেই সূত্রেই অনুসন্ধান চালিয়ে বুধবার পুর কতৃর্পক্ষ জেনেছেন, শহরে ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে ১৫০-এর বেশি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে স্টেশন চত্বরে ৪০টি। কিন্তু সব মিলিয়ে লাইসেন্স আছে মাত্র ১২টির। যার অর্থ, সিংহভাগ হোটেলই চলছে অবৈধ ভাবে।
মুদ্রার অন্য পিঠে রয়েছে চূড়ান্ত অযত্নের ছাপ। হাওড়া স্টেশন ও মাছ বাজার সংলগ্ন হরিমোহন বোস রোড, ডবসন রোড, মুখারাম কানোরিয়া রোড-সহ প্রায় প্রতি রাস্তাতেই গায়ে-গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে বহু পুরনো হোটেল-লজ। কোনওটার দেওয়ালের রং চটা। কোনওটা চড়া মেকআপ নিয়ে হাঁ-মুখ করে রয়েছে। অধিকাংশের ভিতরের ছবিটা আরও বিবর্ণ। ঘুপচি ঘরে একটা খাট। বাকিটায় এক জন মানুষের ভাল ভাবে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কোনও ঘরে আবার খাট বা চৌকির বিলাসিতাও নেই। স্রেফ সিমেন্টের বেদিতে গদি পাতা! বিছানা তেলচিটে, শতচ্ছিন্ন। টিমটিমে আলো। সব ঘরে শৌচাগার নেই। নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। লোক বুঝে ভাড়া ঠিক হয়। তবে কয়েক ঘণ্টার জন্য নিলে ভাড়া বেশি, দিন হিসেবে কম। পুলিশ সূত্রের খবর, বড় ও মাঝারি মানের হোটেলের যদিও বা কিছু ছিরিছাঁদ থাকে, অধিকাংশ লজের যেন শ্বাস-ওঠা অবস্থা। তাদেরই একটি সুমিতবাবুর ব্রিজ লজ। দীর্ঘ কয়েক বছর লাইসেন্স নবীকরণ না করায় এই হোটেলটিও পুরসভার খাতায় ‘অবৈধ।’ ম্যানেজার আশিস মান্না বলেছেন, “আমি কিছু দিন হল এখানে কাজ করছি। কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়।” তবে অযত্নের ছাপ যতই থাকুক, হোটেল ও লজগুলির ব্যবসায় ভাটা পড়ে না।
শহর জুড়ে বেআইনি হোটেল ব্যবসার এই রমরমার জন্য বাম আমলকেই দায়ী করেছে মাস ছয়েক আগে গঠিত তৃণমূল পুরবোর্ড। অভিযোগ, আগের পুরকর্তারা শহর জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল, পানশালা, রেস্তোরাঁ তৈরির অনুমতি দিয়েছেন। প্রায় তিরিশ বছর আগের তৈরি হওয়া পুর-আইন মেনেই হোটেলগুলির লাইসেন্স নেওয়া হচ্ছে। ফলে বেআইনির মতো বাজারমূল্যে রাজস্ব পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে পুরসভা। তাদের মতে, যে হোটেলের বার্ষিক ফি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা, তারা দেয় মাত্র দেড়-দু’হাজার টাকা। সাম্প্রতিক ঘটনার পর এখনকার পুরবোর্ডের সিদ্ধান্ত, কয়েক দিনের মধ্যেই পুর কমিশনারের নেতৃত্বে দল গড়ে লাইসেন্স না-থাকা হোটেল চিহ্নিত করার কাজ শুরু করবে। হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “বিগত পুর-বোর্ডের জন্য পুরসভার বছরের পর বছর রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। আমরা ঠিক করেছি লাইসেন্স-বিহীন সব হোটেলের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে।” হাওড়া পুরসভার বিল্ডিং দফতর সূত্রে খবর, বর্তমান পুর আইনে হোটেল তৈরি করতে গেলে তা বিল্ডিং আইনের ‘অ্যাসেমব্লি’ তালিকায় ফেলা হয়। তালিকা অনুযায়ী, কমপক্ষে ১০০০ বর্গফুটের দু’তিন তলা হোটেলের জন্য সামনে দু’মিটার ও পিছনে চার মিটার ছাড় দিতে হবে। দু’পাশে ছাড় দিতে হবে দেড় মিটার করে। আগুন লাগলে দমকলের গাড়ি ঢোকার মতো পরিসর রাখতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ হোটেল তৈরির সময়ে এর কোনও কিছুই মানা হয়নি।
বাম আমলের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠায় হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র সিপিএমের মমতা জায়সবালের প্রতিক্রিয়া, “এটা ঠিকই, হাওড়া শহর জুড়ে প্রচুর বেআইনি হোটেল গজিয়ে উঠেছে, যাদের লাইসেন্স নেই। আসলে পুরসভায় লাইসেন্স দফতরের এক শ্রেণির কর্মীর সঙ্গে ওই সব হোটেল কর্তৃপক্ষের গোপনে টাকার রফা হয়। তাই পুরসভায় রাজস্ব জমা না পড়ে ওঁদের পকেটই ভারী হত।”
এক দিকে বেআইনি ব্যবসা, অন্য দিকে অসামাজিক কাজকর্ম নিয়ে কী বলছে হাওড়ার সিটি পুলিশ?
নজরদারির অভাবের কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন পুলিশ কর্তারা। বর্তমানে হাওড়া পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সদর দফতরে এক জন ডিসি এবং এক জন ইনস্পেক্টর আছেন। আশপাশের থানাগুলি চলছে এক জন সাব-ইনস্পেক্টর এবং তিন-চার জন কনস্টেবলকে নিয়ে। তাঁরা মূলত পাসপোর্ট আর ভিআইপি-দের যাতায়াত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ফলে হোটেল-লজে কোথায় কী হচ্ছে জানতেই পারে না পুলিশ। এক পুলিশকর্তা জানান, বছর তিনেক আগে কমিশনারেট গড়ার পরে সরাই আইন অনুযায়ী হোটেল-মালিকদের ‘সেল্ফ ডিক্লারেশন’ চাওয়া হয়েছিল। এতে লাইসেন্সের পূর্ণাঙ্গ তথ্য, ঘরের অবস্থা, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, সিসিটিভি আছে কি না, এ সবই জানতে চাওয়া হয়। তখন কিছু হোটেল ও লজ ওই সব তথ্য দিলেও তা যাচাই করা হয়নি।
এ বার কী হয়, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy