Advertisement
E-Paper

পরামর্শ দিন, আয় করুন পার্থর সংসদে

উচ্চশিক্ষা সংসদের মাথায় শিক্ষামন্ত্রীকে বসানো নিয়ে বিতর্কের রেশ এখনও মিলোয়নি। তার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিলের অন্য একটি ধারা নিয়ে তৈরি হল নতুন বিতর্ক। বিধানসভায় পাশ হয়ে যাওয়া এই বিলের মাধ্যমে মন্ত্রীকে সংসদের নেতৃত্বে বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর ছড়ি ঘোরানোর বন্দোবস্ত পাকা করা হচ্ছে বলে আগেই অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। এ বার তাঁরা সরব হয়েছেন, সংসদের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনে রীতিমতো ‘ফি’ দিয়ে পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা দেখে।

সাবেরী প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০৪:১৩

উচ্চশিক্ষা সংসদের মাথায় শিক্ষামন্ত্রীকে বসানো নিয়ে বিতর্কের রেশ এখনও মিলোয়নি। তার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিলের অন্য একটি ধারা নিয়ে তৈরি হল নতুন বিতর্ক।

বিধানসভায় পাশ হয়ে যাওয়া এই বিলের মাধ্যমে মন্ত্রীকে সংসদের নেতৃত্বে বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর ছড়ি ঘোরানোর বন্দোবস্ত পাকা করা হচ্ছে বলে আগেই অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। এ বার তাঁরা সরব হয়েছেন, সংসদের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনে রীতিমতো ‘ফি’ দিয়ে পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা দেখে। তাঁদের বক্তব্য, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এমন বহু বার হয়েওছে। কিন্তু এখন আইন বানিয়ে তাঁদের ‘ফি’ দেওয়ার বন্দোবস্ত করে রাজ্য সরকার আসলে নিজের কাছের লোকেদের আর্থিক পুরস্কারের রাস্তাই খুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বুধবার বলেন, ‘‘আমি তো বলছি, এই বিলে দলবাজির রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সর্বত্র নিজেদের লোক বসিয়ে তাঁদের কিছু পাইয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী কাজ আছে শাসক দলের!’’

উচ্চশিক্ষা সংসদে বাইরের মতামত নেওয়া এমনিতে কোনও নতুন ঘটনা নয়। কোনও কলেজকে নতুন বিষয় চালু করার অনুমতি দেওয়া হবে কি না, ইউজিসি কোনও নির্দেশ পাঠালে তা কী ভাবে প্রয়োগ করা হবে— এমন নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে মতামত নেওয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে বাম আমল থেকেই। শিক্ষা দফতরের এক কর্তার কথায়, এত দিন বিশেষজ্ঞদের ডাকতে হলে যাতায়াতের খরচ বা ট্রাভেলিং অ্যালাওয়্যান্স (টিএ) দেওয়াটাই ছিল দস্তুর। এ ছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ ‘ভাতা’ও দেওয়া হতো। তবে এ সবই করা হতো প্রথা মেনে। আইনে এর কোনও সংস্থান ছিল না।

তৃণমূল সরকার সেই প্রথাকেই এ বার আইনের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার পরিধিও বাড়িয়েছে। কী রকম? বিল-এ বলা হয়েছে, সুষ্ঠু ভাবে কাজ চালানোর জন্য কোনও ব্যক্তির সহযোগিতা বা পরামর্শ প্রয়োজন মনে করলে সংসদের কাজে তাঁকে যুক্ত করা হবে। তিনি সংসদের বিভিন্ন আলোচনা, বৈঠকে উপস্থিত থেকে নিজের মতামত দেবেন। এ জন্য তাঁকে ‘সিটিং ফি’ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তিনি পাবেন আসা-যাওয়ার খরচ। তবে ‘সিটিং ফি’ বাবদ কত টাকা দেওয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান সংসদের এক কর্তা।

কিন্তু এই নিয়ে বিরোধীরা সরব কেন? তাঁদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় এসে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে দলতন্ত্র দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা বাম জমানার অনিলায়নকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথায় নিজেদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোক বসানো, ছাত্র সংসদগুলির অবাধ দাপাদাপি থেকে শুরু করে ক্রমশই শিক্ষাক্ষেত্রে স্বশাসনের পরিসরকে সরকারি হস্তক্ষেপের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষা দফতরে ব্রাত্য বসুকে সরিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আনার পরে এই প্রক্রিয়া আরও গতি পেয়েছে বলেও মনে করেন শিক্ষাজগতের অনেকেই। সম্প্রতি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতিতে রাজ্যপালের ক্ষমতা খর্ব করে প্রায় পুরোটাই সরকারের এক্তিয়ারে আনার চেষ্টা হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে বিলটি বাতিল করা হয়। কিন্তু এখন শিক্ষামন্ত্রীকে যে ভাবে উচ্চ শিক্ষা সংসদের মতো স্বশাসিত সংস্থার মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে স্বজনপোষণ এবং সরকারি হস্তক্ষেপের রাস্তাই প্রশস্ত হবে বলে আশঙ্কা শিক্ষাজগতের।

এই আবহেই পরামর্শের বিনিময়ে মূল্য ধরে দেওয়ার ব্যবস্থা বিরোধীদের কপালে ভাঁজ ফেলছে। কখনও নানাবিধ ভূষণ-রত্ন পুরস্কার বিতরণ, কখনও বিভিন্ন সরকারি কমিটির সদস্যপদ দান, কখনও নির্বাচনী টিকিট বিলি, কখনও দান-ধ্যান-খয়রাতি, কখনও বা অন্য সুযোগসুবিধা— নিকট জনেদের নানা ভাবে পারিতোষিক বিলিয়ে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম শিবির থেকে আচমকা রং বদল করার পরে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষকে কারিগরি শিক্ষা সংসদের মাথাতেও বসিয়েছিলেন। এ বার শিক্ষায় পরামর্শ-মূল্য চালু করে ‘পাইয়ে দেওয়া’র এই রাজনীতিতেই নতুন পন্থা জোড়া হল বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। সংসদের প্রাক্তনীদের একাংশই কবুল করছেন, এখন সংসদের প্রশাসনিক দায়িত্বই বেশি। সেখানে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনার প্রয়োজন কতটুকু, প্রশ্ন তাঁদের।

বিরোধীদের আবার আশঙ্কা, যখন খুশি বাইরে থেকে ‘বাছাই’ করা লোক নিয়ে এসে সংসদের স্বাধিকারেই হাত দেওয়া হতে পারে। রাজ্যের প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘বিলের এই ধারাটি অত্যন্ত রহস্যজনক। এর মানে কি সংসদের বৈঠকে নিয়মিত একাধিক বাইরের লোক উপস্থিত থাকবেন?’’ শিক্ষাবিদদের প্রশ্ন— যে সংস্থার প্রধান খোদ শিক্ষামন্ত্রী, সেখানে ‘সহযোগিতা ও পরামর্শের’ জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বদলে মন্ত্রীর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ই প্রধান
বিচার্য হবে কি? সংসদের বৈঠকে তেমন কিছু মানুষকে ‘পুরস্কৃত’
করে তাঁদের ‘আনুগত্য’ নিশ্চিত করা হবে কি? আইআইএম কলকাতার শিক্ষক অনুপ সিংহর কথায়, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী যদি নিজের লোককে যুক্ত করতে চান তা হলে ঠেকানো মুশকিল। কারণ আইন করে সংসদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে তাঁকে।’’
আর বিরোধী দলের এক অধ্যাপক-বিধায়ক বলেন, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞেরা এসেই থাকেন। কিন্তু সে জন্য টাকা দেওয়া হয় বলে শুনিনি।’’

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, এই অভিযোগ ঠিক নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা শিক্ষার উৎকর্ষের জন্যই বহিরাগত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে চাই। এঁদের কেউ হয়তো ভিন্‌রাজ্যে, কেউ বা ভিন্‌দেশে থাকেন। তাঁদের আনতে হলে তো ফি দিতেই হবে। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কী আছে!’’ উচ্চশিক্ষা দফতরের এক অন্যতম শীর্ষকর্তার বক্তব্য, ‘‘সংসদের কাজের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল কয়েক জন শিক্ষকের পরামর্শেই এই আইন রচিত। তাঁরা নিশ্চয়ই সব দিক বিচার করে পরামর্শ দিয়েছেন।’’

বিরোধীরা এ কথা মানছেন যে, শিক্ষার উন্নয়নে পরামর্শ নিতে বিশেষজ্ঞের দরকার হয়। কিন্তু তাঁদের দাবি, বর্তমান সরকার দল না-দেখে চলে না। তাই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযু্ক্তিগত পরিকাঠামো উন্নয়নের সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ডেকে আনা হয়েছিল। অভিজিৎবাবু তৃণমূলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন। শিক্ষা জগতের একাংশ এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ছবিটা কিন্তু বাম আমলেও খুব আলাদা ছিল না। উচ্চ শিক্ষা সংসদ সূত্রের খবর, বাম আমলে সংসদের সদস্যেরাই মূলত বিভিন্ন সাব কমিটিতে থাকতেন এবং তাঁরা বেশির ভাগই বাম ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে কলা ও বিজ্ঞান শাখায় পঠনপাঠনের দিশা ঠিক করতে এক বার কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বহিরাগত বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলা শাখায় তপন রায়চৌধুরী এবং বিজ্ঞান শাখায় সুশান্ত দত্তগুপ্তের মতো শিক্ষাবিদদের ডাকা হয়েছিল।

সংসদের যুক্তি, ভাল বিশেষজ্ঞ পাওয়ার জন্যই এখন ‘ফি’ দেওয়ার বিষয়টি বিষয়টিকে আইন করে
বেঁধে নেওয়া হল। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলছেন, ‘‘যে কোনও বিলের উদ্দেশ্য বেঁকা ভাবে দেখব কেন? যদি সঠিক ভাবে কার্যকর হয় তবে তো বাইরের পরামর্শ নেওয়া ভাল।’’ শিক্ষাবিদ-সাংসদ সুগত বসুরও মত হল, ‘‘বাইরে থেকে কাউকে আনা হলে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে উঠে নিরপেক্ষ মতামত পাওয়ার সুযোগ থাকে।’’ অর্থাৎ ‘ফি’ দিয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ এনে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে বলেই আশা করছেন সুগতবাবু।

তত্ত্বগত ভাবে এই যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছে না শিক্ষাজগতও। কিন্তু খাতায়কলমে উদ্দেশ্য সাধু হলেও বাস্তবে তা কী চেহারা নেবে, সেটা নিয়েই যাবতীয় প্রশ্ন। উচ্চ শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং এই বিলের অন্যতম পরামর্শদাতা সুগত মারজিত দাবি করছেন, ‘‘আমি এই (ফি সংক্রান্ত) পরামর্শের মধ্যে ছিলাম না। আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম আমি টেলিফোন করেও অনেকের মতামত নিয়েছি।’’ অনুপবাবুর বক্তব্য হল, ‘‘সিটিং ফি কথাটা শুনতে ভাল লাগছে না। এটা সাধারণত কপোর্রেট জগতে ব্যবহার করা হয়।’’

abpnewsletters saberi pramanik cliquism tmc cliquism partha chattopadhyay higehr education council
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy