এক দিকে কেন্দ্রীয় সরকার, অন্য দিকে দেশের বক্ষঃরোগ বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ। বয়স্কদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধক টিকাকে জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচির আওতায় আনার প্রয়োজন কতটা, তা নিয়ে দু’পক্ষের টানাপড়েন আপাতত তুঙ্গে।
চমকপ্রদ ভাবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের অনড় অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রবলতর চাপ সৃষ্টির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’ (এইম্স)-এর মতো চিকিৎসা কেন্দ্র।
তাদের এই অবস্থানের কারণ কী?
এইম্সের চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা, সারা পৃথিবীতে নিউমোনিয়ায় সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হন পাঁচ বছরের কম বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষজন। তাঁদের মধ্যেই এই রোগে মৃত্যুর হার বেশি। ভারতের যে-কোনও হাসপাতালে আইসিইউয়ের রোগীদের হিসেব নিলে দেখা যাবে, ৬৫-৭০ শতাংশ শয্যায় রয়েছেন নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত বয়স্কেরা। এবং তাঁদের মধ্যে ৩০ শতাংশই ‘ইনভেসিভ নিউমোনিয়া’র রোগী। এতে রোগের জীবাণু রক্ত ও দেহরসের মাধ্যমে শরীরে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং রোগীর সেপসিস হয়ে যায়।
চিকিৎসকদের মতে, এর ফলে ওই রোগীদের জন্য আইসিইউয়ের অনেক শয্যা দীর্ঘদিন আটকে থাকে। অন্য রোগীরা জায়গা পান না। ভেন্টিলেটর কে পাবেন, তা নিয়ে মারামারি হয়। সরকারি হাসপাতালে কম টাকায় বা নিখরচায় আইসিইউ পরিষেবা দিতে গিয়ে গড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয় সরকারকে। আর রোগী যদি বেসরকারি হাসপাতালে থাকেন, প্রতিদিন ৪০-৬০ হাজার টাকা খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবার নিঃস্ব হতে বসে। দেশের অর্থনীতির উপরে এই রোগের প্রভাব সরকার বুঝতে পারছে না। সর্বোপরি রোগীর শারীরিক কষ্টভোগ তো রয়েছেই।
ডাক্তারদের আরও যুক্তি, বয়স্কদের নিউমোনিয়া টিকা জাতীয় কর্মসূচিতে ঢুকলে এই সব সমস্যাই এক ধাক্কায় অনেকটা কমতে পারে। দিল্লি এইম্সের জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগের দুই বাঙালি চিকিৎসক অপরাজিত বল্লভ দে এবং প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ভারতে এখন প্রায় ১২ কোটি বয়স্ক মানুষ রয়েছেন। সারা বিশ্বের বয়স্ক জনসংখ্যার একটা বড় অংশ থাকেন এ দেশে। সংখ্যাটা বাড়ছে এবং এই বয়স্কদের ৮০ বছর পার করে বেঁচে থাকার হারও বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিউমোনিয়ায় ইন্ধন জোগানো বায়ুদূষণ। বয়স্কদের একটা বড় অংশের অসুস্থ হওয়া, জীবনযাত্রার মান নষ্ট হওয়া, সারা জীবনের সঞ্চয় জলের মতো খরচের প্রধান কারণই হল নিউমোনিয়া।
‘‘সব জানার পরেও আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা নির্বিকার। তাঁরা শুধু শিশুদের টিকাকরণ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। অথচ বয়স্কদের ‘কোয়ালিটি লাইফ’ দিলে তাঁরাও দেশের অনেক কাজে লাগতে পারেন,’’ বলছেন প্রসূনবাবু। চিকিৎসকদের বক্তব্য, এখন নিউমোনিয়ার টিকা বাজার থেকে কিনতে খরচ হয় ১৫০০-৩০০০ টাকা। অনেকের পক্ষে তা কেনা সম্ভব নয়। বিষয়টি সরকারি টিকা কর্মসূচিতে এলে গরিবদের আর এত টাকা খরচ করতে হবে না।
পিপিপি মডেলে চুক্তিবদ্ধ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে মিলে দিল্লি এইম্সের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা গত দু’বছরে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বয়স্ক মানুষকে নিউমোনিয়ার টিকা দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগদীশপ্রসাদ নাড্ডাকে চিঠি লিখে অবিলম্বে এই টিকা সরকারি কর্মসূচিতে ঢোকানোর আবেদনও জানিয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রকের টিকাকরণ বিভাগের একাধিক কর্তার পাল্টা যুক্তি, এখন দু’টি বিদেশি সংস্থার তৈরি টিকা পাওয়া যায়। দু’টিই শুধু স্ট্রেপটোকক্কাল বা নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া রোধের জন্য তৈরি। এ ছাড়াও অন্য অনেক ধরনের নিউমোনিয়া হয়। তা ছাড়া স্ট্রেপটোকক্কাল নিউমোনিয়া হয় অনেক ধরনের। দু’টি টিকার মধ্যে একটি মোকাবিলা করতে পারে ২৩ ধরনের স্ট্রেপটোকক্কাল নিউমোনিয়ার। অন্যটি ১৩ ধরনের ‘স্ট্রেন’-এর মোকাবিলা করতে পারে। এর বাইরে কারও কোনও নিউমোনিয়া হলে সেটা ওই টিকা প্রতিরোধ করতে পারবে না। তা ছাড়া ভারতে কোন ধরনের স্ট্রেপটোকক্কাল নিউমোনিয়া বেশি হয়, সেটা তো সমীক্ষা করে কখনও দেখাও হয়নি। সেই সমীক্ষার আগে কী করে ওই টিকাকে জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচিতে ঢোকানো যাবে?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ডেপুটি কমিশনার (ইমিউনাইজেশন) প্রদীপ হালদারের কথায়, ‘‘সরকারের লক্ষ্য, পাঁচ বছরের নীচে থাকা শিশুদের মৃত্যুহার কমানো। তার জন্য শিশুদের নতুন নিউমোনিয়া টিকা আসছে, রুবেলার টিকা আসছে। রোটা ভাইরাসের টিকা আরও পরিমার্জিত হচ্ছে। বয়স্কেরা এই মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। সকলকে তো একসঙ্গে অগ্রাধিকার-তালিকায় রাখা যায় না।’’
কী করছে কলকাতা?
সরকার আগ্রহী না-হলেও কলকাতার বক্ষঃরোগ চিকিৎসকদের অধিকাংশই বয়স্ক রোগীদের নিউমোনিয়া টিকা দিতে শুরু করেছেন। ওই চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান চেস্ট সোসাইটি’র গভর্নিং বডির সদস্য ও প্রাক্তন সভাপতি চিকিৎসক আলোকগোপাল ঘোষাল জানান, ভারত-সহ সব দেশেই অধিকাংশ নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী স্ট্রেপটোকক্কাস বা নিউমোকক্কাস জীবাণু। ফলে এর টিকা ব্যবহার করলে অন্তত ৩০ শতাংশ রোগীর রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু সরকার সেটা বুঝতেই চাইছে না। তাঁর দাবি, কলকাতার বেশির ভাগ বক্ষঃরোগ চিকিৎসকই এখন বয়স্কদের এই টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষ করে যাঁরা অতিরিক্ত ধূমপানের জন্য ‘ক্রনিক অস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার’ বা সিওপিডি-তে ভুগছেন বা যাঁদের অন্য কিছু রোগের জন্য রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে, তাঁদের অবশ্যই এই টিকা দেওয়া উচিত বলে জানান আলোকবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy