ঠিক যেন পার্কিং ফি! এক ঘণ্টা পেরিয়ে দু’মিনিট হলেই চার্জ লাগবে দু’ঘণ্টার!
শুধু অপারেশন থিয়েটারের চার্জ ২০ হাজার টাকা প্রতি ঘণ্টা। এর সঙ্গে সার্জেন, অ্যানাস্থেটিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট বা অন্য ডাক্তারের ফি, ওষুধ-ইঞ্জেকশন-সরঞ্জাম তো আছেই। নিট ফল? সামান্য ফোঁড়া কাটানোর খরচও ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সল্টলেক লাগোয়া এক বেসরকারি হাসপাতালে খরচের বহর এমনই!
কম যায় না বাইপাসের আর এক হাসপাতাল। মূলত হার্টের চিকিৎসার জন্য চিহ্নিত ওই হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ভাড়া সাড়ে ছ’হাজার টাকা। এই ভাড়া কিন্তু শুধুমাত্র ওই ঘরটুকুর জন্য। সঙ্গে আইসিইউ-এ ব্যবহৃত অক্সিজেন, পালস অক্সিমিটার, কার্ডিয়াক মনিটর এবং কনসালট্যান্টদের আলাদা খরচ তো আছেই। এমনকী নার্সের খরচও আলাদা! রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার অর্থাৎ আরএমও-র জন্যও আলাদা টাকা গুনতে হয় রোগীদের।
রোগীর বাড়তি পরিচর্যা প্রয়োজন বুঝলেই তো তাঁকে সাধারণ শয্যার বদলে আইসিইউ-এ নিয়ে রাখা হয়। তা হলে আরএমও, নার্সের আলাদা খরচ কেন? কর্তৃপক্ষের যুক্তি, সাধারণ ভাবে আইসিইউ-এ এক জন রোগীর জন্য একজন নার্সকে রাখা হয়। অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক হলে এক জন রোগীর জন্য দু’জনকেও রাখতে হয়। আরএমও-র ক্ষেত্রেও বাড়তি খরচ সেই কারণেই!
সল্টলেক লাগোয়া বেলেঘাটার ওই হাসপাতালের বিল নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য ভবনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক রোগী। তাঁর বিলে দেখা যাচ্ছে, ফাস্টিং ব্লাড সুগার টেস্টের জন্য ৭৪০ টাকা। ইসিজি-র জন্য ৯৩০ টাকা। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাক্তারদের এক-এক জনের জন্য ৪০০ টাকা। নার্সের জন্য ৩০০ টাকা। বিলের অঙ্ক দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন রোগী। এখানেই শেষ নয়। মেডিক্যাল রেকর্ডস-এর জন্যও তাঁর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল ৬০০ টাকা। তিনি কী খাবেন, তা ঠিক করার জন্য ডায়েটিশিয়ানের ফি দিতে হয়েছিল ৫০০ টাকা। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের জন্য এক দিনে নেওয়া হয়েছিল ১৪০ টাকা। ফলে কোনও অস্ত্রোপচার নয়, কোনও গুরুতর অসুখ নয়, সামান্য শ্বাসকষ্টের জন্য ৪৮ ঘণ্টা হাসপাতালে ‘অবজার্ভেশনে’ থেকে ওই রোগীর বিল হয়েছিল ৬০ হাজার ২৯৫ টাকা!
একবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে দিনকয়েক আগে ভাঙচুর হয়েছিল। সেখানকার এক রোগীর অভিজ্ঞতাও কম ভয়াবহ নয়। বিল মেটানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। যখন কাউন্টারের সামনে পৌঁছলেন, তখনই এল ব্রেক-এর সময়। ব্রেক-এর পরে বিলের টাকা দিতে গেলে জানানো হল, আর এক দিনের ভাড়া দিতে হবে। কারণ দুপুর ১২টা বেজে গিয়েছে!
আরও পড়ুন: মুখে ধোঁয়া ছেড়ে ডাক্তার বললেন, ভয়ের কী আছে
সল্টলেকের ওই বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে ঢোকানো মাত্রই তো আর অপারেশন শুরু হয় না। কিছু প্রক্রিয়া চলে। ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। সব মিলিয়ে সময় তো লাগেই। এক ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার নজির খুবই কম। ফলে ন্যূনতম দু’ঘণ্টার জন্য শুধু ওটি ভাড়াই ৪০ হাজার লাগে। আর একই সার্জেন অন্য হাসপাতালে তাঁর যে ফি নেন, এখানে ফি নেন তার চেয়ে অনেকটা বেশি। ফলে সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কটা ফুলেফেঁপে ওঠে।’’
কেন রোগীদের ওপরে এ ভাবে খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়?
ওই হাসপাতালের সিইও রূপালি বসু জানান, তাঁরা প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেন, সেই অনুযায়ীই খরচ হয়। সুতরাং বাড়তি বিলের অভিযোগ খাটেই না। কিন্তু প্রশ্ন হল, গুরুতর অসুস্থ এক জন মানুষকে নিয়ে তাঁর পরিজনেরা যখন হাসপাতালে আসেন, তখন কি তাঁদের বিলের খুঁটিনাটি আগাম বুঝে নেওয়ার অবস্থা থাকে? তাঁদের মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে কি এটা এক ধরনের শোষণ নয়? তিনি বলেন, ‘‘একেবারেই নয়। রোগীর বাড়ির লোক চাইলে যে কোনও তাঁদের রোগীকে আমাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’’
বাইপাসের ওই হার্টের হাসপাতাল অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছে, কিছু কিছু বিলের ক্ষেত্রে সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, আইসিইউ-এ অক্সিজেন দেওয়ার জন্য আলাদা খরচ। হাসপাতালের পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা আর ভেঙ্কটেশ বলেন, ‘‘আমরা এপ্রিল মাসে কিছু সংশোধন করব। তখন হয়তো এই খরচগুলো আর আলাদা করে আর নেওয়া হবে না। ওটা আইসিইউ-এর চার্জের মধ্যেই ধরা থাকবে।’’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের ‘গেস্ট সাপোর্ট সেল’ আছে। প্রয়োজনে সেই সেল রোগীদের চিকিৎসার খরচে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমরা সবটাই জানাব। তবে প্রতিযোগিতার বাজার তো! অন্য হাসপাতাল করছে বলে আমরাও এটা করছি।’’
ভেঙ্কটেশের এই যুক্তিই খাড়া করছে অন্য একাধিক বেসরকারি বেসরকারি হাসপাতাল। তাদের বক্তব্য, অন্যরা করলে আমি করব না কেন? মুখ্যমন্ত্রী যদি সকলের ক্ষেত্রে এক খরচ বেঁধে দেন, তা হলে আমরা সেটা মানতে বাধ্য। নয়তো কেউ বেশি লাভ করবে, আর বাকিরা মুখ শুকিয়ে থাকবে, এটা হতে পারে না। যদিও খোদ একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়া স্বীকার করেছেন, কোনও হাসপাতালেই আইসিইউ-এ অক্সিজেন ও নার্সের আলাদা খরচ নেওয়ার কথা নয়।
এই অবস্থায় রোগীদেরই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের আইনজীবী প্রবীর বসু। তাঁর বক্তব্য ‘‘হাসপাতাল এমন এক শিল্প, যেখানে যে কোনও পরিষেবার দাম যে যার মতো রাখতে পারে। হাসপাতালে ঢোকার আগে তাই রোগীকেই বুঝে নিতে হবে, কোথায় গেলে কী অঙ্কের বিল হতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy