Advertisement
১০ মে ২০২৪
BJP

‘তোরা কোনও দিন মিছিলে যাস না’

তার পরে একে একে এসেছেন বিজেপি নেতারা। এসেছেন বিজেপির জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি বাপি গোস্বামী। তিনি টেলিফোনে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ধরেন।

শোকাহত: ভেঙে পড়েছেন উলেনের স্ত্রী মালতী। নিজস্ব চিত্র

শোকাহত: ভেঙে পড়েছেন উলেনের স্ত্রী মালতী। নিজস্ব চিত্র

অনির্বাণ রায় ও নীতেশ বর্মণ
গজলডোবা ও শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:৪৫
Share: Save:

দুপুর থেকে বছর দশেকের মেয়েটা অপেক্ষা করে বসে আছে। ছোট্ট খোপা করে সেজেছেও। বাবা বলে গিয়েছেন, ফিরে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে গেল, বাবা ফিরলেন না। তার পরে হঠাৎ টিভির পর্দায় বাবার ছবি। জামা খোল, বুকে কালশিটে। মেয়েটি চিৎকার করে মাকে ডাকল, ‘‘বাবাকে টিভিতে দেখাচ্ছে।’’ ততক্ষণে দলের ছেলেরা চলে এসেছে। সারা পাড়া জেনে গিয়েছে উত্তরকন্যা অভিযানে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে উলেন রায়ের।

তার পরে একে একে এসেছেন বিজেপি নেতারা। এসেছেন বিজেপির জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি বাপি গোস্বামী। তিনি টেলিফোনে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ধরেন। তার পরে কথা বলিয়ে দেন উলেনের স্ত্রী মালতী দেবীর সঙ্গে। বুক ভাঙা কান্নায় ততক্ষণে ভেঙে পড়েছেন মালতী। ফোনের ওপারে দিলীপবাবুকে তিনি বললেন, ‘‘আমার বাড়িতে এসে দেখে যান, কী ভাবে বেঁচে আছি।’’ প্রশ্ন করলেন, ‘‘এ কেমন পার্টি করা, কেমন আন্দোলন, যাতে মানুষ মরে?’’ একই সঙ্গে বললেন, ‘‘আমার তিন ছেলেমেয়ে। এদের দেখতে হবে আপনাদের।’’ দল সূত্রে খবর, দিলীপবাবু তাঁকে আশ্বাস দেন। পরে জেলা সভাপতি বাপি গোস্বামীও মালতীদেবীকে জানান, পরিবার ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব দলের।

শাল, সেগুন গাছের ঘন বৈকুন্ঠপুর জঙ্গল ঘেরা একটি ছোট্ট গ্রাম মেনঘোড়া। সেই গ্রামেই ছোট একটি চা বাগান রয়েছে বছর পঁয়ষট্টির উলেনবাবুর। তাঁর মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে পাড়া পড়শিরা উঠোনে ভাড়া করা আলো লাগিয়ে দেন এ দিন। ডুকরে ওঠেন উলেন রায়ের দিদি শান্তিবালা। বলেন, ‘‘সারা জীবন পার্টি পার্টি করল। কিন্তু কী পেল? সবাইকে পথে বসিয়ে গেল।’’

মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে বলে এ দিন উলেনকে মিছিলে যেতে মানা করেন মালতি।

স্বামীর মৃত্যুর খবরের সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীকে জানানো হয়েছে, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বাড়িতে আসবে। ঝাঁঝিয়ে ওঠেন স্ত্রী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এমন করে আন্দোলন হয় নাকি? কেন কেউ গুলি ছুড়বে, মিছিলে কেউ পাথর ছোড়ে নাকি! ওঁরা (দলের নেতারা) পারবে মানুষটাকে ফিরিয়ে দিতে।’’ উলেনের বাবা স্বর্গেনবাবুর বয়স নব্বই ছুঁয়েছে। একসময়ে তিনি এসইউসিআইয়ের হয়ে পঞ্চায়েত ভোটেও লড়েছেন। তিনি মাঝে মধ্যেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন তিনি।

এক ছেলে নবম শ্রেণিতে, অন্য ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। মায়ের পাশে ঠায় বসে ছিল দুজন। মালতীদেবী দুই ছেলেকে বললেন, ‘‘কোনও দিন তোদের মিছিলে যেত দেব না। পার্টি করবি না তোরা।’’

রাত বাড়তে থাকে। নিঃশেষ হয়ে আসে বাড়ির সকলের ধৈর্য। তার পরে রাত আটটা নাগাদ বিজেপির স্থানীয় নেতারা আসেন। কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তার পরে চলে যান তাঁরা। মালতীদেবীর শূন্য দৃষ্টি পড়ে থাকে দূরে অন্ধকারের দিকে।

হাসপাতালে উলেন রায়ের দেহ অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়েছে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যেতে। তখনও ফুলবাড়ি ক্যানেল মোড়ের পাশে নার্সিংহোমে পৌঁছননি বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। খবর এল, আরও ১০ মিনিট লাগবে। তড়িঘড়ি বিজেপির নেতা-কর্মীরা অ্যাম্বুল্যান্সটিকে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখেন। কৈলাস নার্সিংহোমে পৌঁছে বললেন, ‘‘পুলিশ ও তৃণমূলের গুন্ডারা মিলে দলীয় কর্মীদের উপর হামলা করেছে। তাতেই উলেনের মৃত্যু হয়েছে।’’ একই দাবি জানিয়েছেন দিলীপ ঘোষ।

পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘সন্ত্রাস তৈরি করেছে বিজেপি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা থেকে গুন্ডাদের দিয়ে মিছিল করানো, সবই তাদের কীর্তি। মানুষ দেখেছেন, কারা গণতন্ত্র মানছে না।’’

নার্সিংহোমে ছিলেন মালতীর দাদা হরকিশোর রায়। তিনি বলেন, ‘‘কোথা থেকে কী ঘটে গেল, বুঝতে পারছি না।’’ উলেনের সঙ্গী প্রেমানন্দ রায় বলেন, ‘‘এমন একজনকে পুলিশ মেরে ফেলল, এর জবাব মানুষ দেবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Ulen Roy UttarKanya Movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE