Advertisement
E-Paper

এক সিলিন্ডার আর দুই শেরপায় রক্ষা চেতনার

হাতের আঙুলগুলো বরফে মারাত্মক জখম হয়ে গিয়েছে। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। শরীর অবসন্ন। এই অবস্থায় দল থেকে পিছিয়ে পড়ছিলেন চেতনা সাহু। চেতনা কমে আসছিল।

সৌমিত্র কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০৩:৪৩
শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে চেতনা সাহু। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে চেতনা সাহু। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

হাতের আঙুলগুলো বরফে মারাত্মক জখম হয়ে গিয়েছে। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। শরীর অবসন্ন। এই অবস্থায় দল থেকে পিছিয়ে পড়ছিলেন চেতনা সাহু। চেতনা কমে আসছিল।

গত দু’বছর ধরে এভারেস্ট অভিযান হয়নি। বেসক্যাম্প থেকে ফিরে যেতে হয়েছে চেতনা সাহু এবং তাঁর স্বামী প্রদীপ সাহুকে। এ বার তাই সুযোগ হারাতে চাননি ওঁরা। শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে অসুস্থ স্ত্রীয়ের বিছানার পাশে বসে প্রদীপবাবু বলছিলেন, এই অভিযানে কী ভাবে ভারতের প্রথম দম্পতি হিসেবে এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেললেন ওঁরা। আর তার পরে কী ভাবে খারাপ আবহাওয়ার মুখে পড়ে অসুস্থ চেতনা পড়ে গেলেন বিষম বিপদে!

একাধিক অভিযানের সাফল্য সঙ্গে নিয়ে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন সাহু-দম্পতি। সঙ্গী ছিলেন দেবরাজ দত্ত। দক্ষ পর্বতারোহী হিসেবে তিনিও পরিচিত দেশে-বিদেশে। এ বারের অভিযানের আগে সব রকম অঙ্ক কষে এগোনোর পরিকল্পনাই করেছিলেন তিন জন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলেছিল, ১৮-১৯-২০ তারিখের একটি ‘উইন্ডো’ রয়েছে। অর্থাৎ, আবহাওয়ার নিরিখে মে মাসের ১৮ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে এভারেস্ট শীর্ষ ছোঁয়ার অভিযান চালানো সব থেকে ভাল। সেই মতো তাঁরা ক্যাম্প ফোর বা সামিট ক্যাম্পে পৌঁছে যান।

প্রদীপবাবু বলছিলেন, ‘‘১৯ তারিখ বেলা ১০টা ৪৫ মিনিটে আমি আর দেবরাজ চুড়োয় উঠি।’’ চেতনা ছিলেন তাঁদের থেকে কিছুটা পিছনে। শারীরিক ভাবে তখনই বেশ সমস্যা বোধ করছিলেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই মহিলা অভিযাত্রী। শেষ পর্যন্ত তিনি চুড়োয় ওঠেন। এর পর শুরু হয় নেমে আসার অভিযান। আর তখনই দেখা দেয় বিপদ। বাতাসের গতি হঠাৎই বেশ বেড়ে যায়। সন্ধের মুখে ক্যাম্প ফোরে ফেরেন প্রদীপ ও দেবরাজ। কিন্তু চেতনা তখনও ফেরেননি।

‘‘দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। ভয়ও লাগছিল। কখন কী হয়, কেউ জানে না।’’— বললেন প্রদীপ। সব চেয়ে ভয় ছিল, অক্সিজেনের ঘাটতি। দেবরাজ জানান, বেসক্যাম্পে চূড়ান্ত খুঁটিনাটি পরীক্ষার সময় একটা জিনিস তাঁর নজরে এসেছিল। সেটা হল অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলির চাপ কম। সাধারণত অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলির চাপ থাকে অন্তত ২৪০ মিলিবার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের চাপ ছিল ২০০ মিলিবার। তাঁর দাবি, ওই সিলিন্ডারগুলি সম্ভবত পুরনো। গত দু’বছর অভিযান বাতিল হয়েছে। তাতে ব্যবহার না হওয়া সিলিন্ডারগুলিই হয়তো দেওয়া হয়েছিল এ বারে। দেবরাজের বক্তব্য, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, মেপে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে। ‘‘চেতনার ফিরতে যত দেরি হচ্ছিল, ততই ভয় বাড়ছিল। কারণ, হিসেব বলছিল, যে অক্সিজেন ওর কাছে আছে, তা দিয়ে বেশি ক্ষণ চলবে না।’’ — বললেন প্রদীপ।

সন্ধের পরে চেতনার সঙ্গী পূর্বা শেরপা যোগাযোগ করেন ওয়াকিটকিতে। জানান, ক্লান্ত চেতনা নামতে পারছেন না। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘দুই শেরপার সঙ্গে অক্সিজেন দিয়ে তাঁদের ওপরে পাঠিয়ে দিই। চেতনা ক্যাম্পে ফেরে রাত দু’টোয়।’’ এই প্রসঙ্গেই দেবরাজ জানালেন বিপদের মুখে পড়া অন্য চার বাঙালি অভিযাত্রীর কথা। ‘‘নীচের ক্যাম্পগুলিতে শেরপা আর অক্সিজেনের ‘ব্যাক আপ’ থাকলে, এড়ানো যায় বিপদের সম্ভাবনা।’’

চেতনা তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ক্লান্ত ছিলেন দেবরাজ এবং প্রদীপও। সে সব তোয়াক্কা না করে পরের দিনই ক্যাম্প থ্রি-র পথ ধরেন। চেতনাকে নিয়ে নামতে সময় লাগছিল অনেক। পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। দেবরাজ অবশ্য ওই ক্যাম্পে না থেকে নেমে যান ক্যাম্প টু-তে। পরের দিন সেখানে নেমে আসেন প্রদীপ-চেতনাও।

একটি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে ক্যাম্প টু থেকে বেস ক্যাম্প। পরে সেখান থেকে কাঠমান্ডু। ২২ মে এসে পৌঁছন শিলিগুড়িতে। এখানে প্রদীপবাবুর দাদার নার্সিংহোম রয়েছে। সেখানেই ভর্তি চেতনা।

এখানেই খবর পাচ্ছেন পাহাড় থেকে। কখনও রাজীব ভট্টাচার্য, সুভাষ পালের মৃত্যুর খবর। কখনও পরেশ নাথ, গৌতম ঘোষদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর। ২০ তারিখ শৃঙ্গ থেকে নামার সময় গৌতমদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে কথা বলছিলেন প্রদীপ— ‘‘গৌতমদের ২১ মে শৃঙ্গে ওঠার কথা ছিল। ওর আর সুনীতার সঙ্গে বেসক্যাম্পে প্রতিদিনই কথা হতো। ওরা যখন যাচ্ছিল, তখনও একটু কথা হল।’’ বলছিলেন, ‘‘গৌতমের সঙ্গে ১৯৯২ থেকে পাহাড়ে উঠছি। আমাদের দু’জনেরই খুব কাছের মানুষ ও। কী যে হল!’’ একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘মনটা একেবারে ভাল নেই, জানেন!’’

এত বড় বিপদ কেন হল তাঁদের? সদ্য এভারেস্ট ছুঁয়ে আসা এবং একাধিক সাত-হাজারি শৃঙ্গ ছুঁয়ে আসা দেবরাজ বলছেন, যথেষ্ট অক্সিজেনের জোগান নিশ্চিত করা খুব জরুরি। ওই দুর্গম পথে ক্লান্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ক্লান্তি যাতে বিপদ না বাড়ায়,সে জন্য দরকার পর্যাপ্ত অক্সিজেন।

অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, যে কোনও বড় শৃঙ্গ অভিযানের ক্ষেত্রেই, সামিট থেকে ফেরার সময় খুব বেশি হলে বেলা বারোটা। এর মধ্যে শৃঙ্গ ছোঁয়া যদি না-ও হয়, তবু বিপদের কথা ভেবে নেমে আসা উচিত আরোহীদের। কারণ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভাবনা বাড়ে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার।

চেতনার দু’হাতে ব্যান্ডেজ। বেশির ভাগ আঙুলে বরফের ক্ষত। চিকিৎসকরা বলছেন, ক্ষত সারতে দু-তিন মাস তো লাগবেই। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপবাবু। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে স্ত্রীকে এখান থেকে কবে নিয়ে যাবেন, সেই চিন্তাভাবনাই চলছে। সন্তানরাও তাঁদের পথ চেয়ে আছেন।

everest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy